মিয়ানমারের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে বিরাজ করছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। এ নিয়ে সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পরে নতুন করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় সীমান্তে বাড়তি নজরদারি বাড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এছাড়া মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের জলসীমায় নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে।
এ অবস্থায় রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে এপারে পালিয়ে আসার জন্য রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা তাদের স্বজনদের কাছে নিয়মিত যোগাযোগ করে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ-খবরও নিচ্ছেন। মিয়ানমারের এমন পরিস্থিতিতে আবারো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শংকা বাড়ছে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের কাছে।
টেকনাফের শালবাগান শিবিরের মোহাম্মদ শওকত নামের একজন রোহিঙ্গা এ বিষয়ে বলেন- মিয়ানমারের ভুসিডং এলাকায় আমাদের বসবাস ছিল। ২০১৭ সালের আগস্টে পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমি আমার পরিবারকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার চাচা, ভাইসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন তখন থেকে ঝুঁকি নিয়ে সেখানে রয়ে গেছে। পরবর্তীতে সেখানে বসবাস করতে তাদের তেমন সমস্যা হয়নি। তবে গত কয়েকদিন আগে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা এখন খুব চিন্তায় পড়েছে। সেনা শাসনে তাদের ওপর নতুন করে কোন নিপীড়ন হবে কিনা তা নিয়েও তারা আতঙ্কে আছে।
তিনি আরো বলেন, ওপারে থাকা আত্মীয় স্বজনরা বাংলাদেশে চলে আসতে তাদের কাছে বার বার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্ত পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা আসলে দেশে ঢুকতে পারবে।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী ছলেমা খাতুন বলেন- মংডুতে এখনো আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন থেকে গেছে। তারা এতদিন সেখানে নিরাপদে ছিল। মগ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা কিছুটা ভয়ে আছে।’ তিনি বলেন, এখন যারা ক্ষমতা নিয়েছে এই সেনাবাহিনীই রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের পুরোটা অংশ জুড়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা এখন সেখানকার রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হবে, সেরকম আশা করা যাচ্ছে না।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন- আমরা আশা করছি মিয়ানমারের নতুন সেনা প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন বিষয়ে অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসুক সেটা আমাদের মোটেও কাম্য নয়। আমরা চাচ্ছি, প্রত্যাবাসন আলোচনা অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হোক। তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গা স্বজনরা এপারে চলে আসার পরামর্শ চাইলে আমরা তাদের আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছি। নতুন করে কোনো রোহিঙ্গার আগমন ঘটলে, আগে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও ভেস্তে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে ফেরার স্বপ্নভঙ্গ হতে পারে।
কুতুপালং শিবিরের আব্দুল হামিদ ও নুর মোহাম্মদ নামের দুই রোহিঙ্গা নেতা অবশ্য ভিন্নমতের কথা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের এই সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা চালিয়েছিল তারা আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে সেই ঘটনা নিয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের রায়েও তারা দোষীসাব্যস্ত হয়েছে। সেই সেনাবাহিনী নতুন করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর আবার অত্যাচার-নির্যাতন চালাবে বলে মনে হয় না। এ কারণে তিনি নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করেন না।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারে রাখাইনে কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা হওয়ার পরে রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসে দুর্যোগের ঝড়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। আগে আশ্রয় নেওয়াসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে বসবাস করছেন। সম্প্রতি সেখান থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে৷
এদিকে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, বিজিবি সীমান্তে সর্তক অবস্থানে রয়েছে। কেউ যদি অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে, কতৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি নতুন করে যাতে কেউ অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তার বক্তব্য, সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়টি তাদের নিজেদের ব্যাপার। সেটার সঙ্গে সীমান্তের এই মুহূর্তে কোনো সম্পর্ক নেই।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদও জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং কোনো অবৈধ অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-এর অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মো. তারিকুল ইসলাম বলেন রোহিঙ্গা শিবিরে যাতে অপ্রত্যাশিত কিছু না ঘটে সেদিকেও নজর আছে তাদের, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ