বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা বগুড়ায় ১১ই নভেম্বরের পর থেকে গত এক মাসে কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় অন্তত চার জন আওয়ামী লীগ নেতা মারা গেছেন। ‘নাশকতা’ কিংবা ‘হত্যা মামলার’ আসামী হিসেবে তাদের আটক করা হয়েছিলো।
‘হার্ট অ্যাটাক কিংবা অন্য অসুস্থতায়’ এদের মৃত্যু হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ বললেও নিহতদের একজনের সন্তান বিবিসিকে বলেছেন তার বাবা ‘কখনোই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন না’ এবং কারাগারে যখন তারা সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন তখনও কোন অসুস্থতার কথা তার বাবা তাদের জানাননি।
কারাগারে আটক অবস্থায় মারা যাওয়া আরও দুজনের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে আওয়ামী লীগ বলছে ‘এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’।
যদিও কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন আওয়ামী লীগের এসব নেতারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে।
তবে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলছেন কারাগারেই হোক আর পুলিশ হেফাজতে হোক- এ ধরনের মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত কারাগারে হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৬২ জনের। এদের মধ্যে বিচারাধীন বন্দি ছিলেন ৩৯ জন আর সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ছিলেন ২৩ জন।
প্রসঙ্গত, আন্দোলনের মুখে গত ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে বিদায়ী সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন কিংবা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন এমন বহু মানুষকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের বহু নেতা, কর্মী ও সমর্থককে ‘নাশকতা’ কিংবা ‘হত্যা মামলায় আসামী করা হয়েছে, যাদের অনেককে এর মধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ভারতের অবস্থানরত দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে আড়াইশোর বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব মামলায় জুলাই ও অগাস্টের ‘আন্দোলনের সময় গুলি করে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগ আনা হয়েছে।
বগুড়া কারাগারে আটক আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে সবশেষ সোমবার মারা গেছেন জেলার গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মিঠু। তিনি তার দলের ইউনিয়ন কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন।
একটি হত্যা মামলার আসামী হিসেবে আটকের পর গত তেসরা নভেম্বর তাকে বগুড়া কারাগারে নেয়া হয়েছিলো।
কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সোমবার ভোরে তিনি বুকে ব্যাথা অনুভব করলে তাকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এরপর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এর আগে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল লতিফ, বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম রতন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদত আলম ঝুনুও আটক থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
আব্দুল লতিফ গত ২৫শে নভেম্বর আর শহিদুল ইসলাম ১১ই নভেম্বর মারা গিয়েছিলেন । শাহাদত আলম ঝুনুকে তিনটি হত্যা মামলাসহ মোট পাঁচটি মামলার আসামী করা হয়েছিলো।
তাকে গত পঁচিশে অগাস্ট তার বগুড়ার বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করেছিলো। তারপর থেকে তিনি জেলা কারাগারে ছিলেন এবং কারাগারে থাকা অবস্থাতেই গত ২৬শে নভেম্বর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বগুড়ার জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু ঢাকায় নেয়ার পথেই সিরাজগঞ্জে মারা যান তিনি।
মি. ঝুনুর চৌদ্দ বছর বয়সী সন্তান রিয়াদ উল আলম তার মায়ের অনুমতিক্রমে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন। এ সময় তার মা পাশেই ছিলেন।
বিবিসিকে তিনি বলেছেন, “মায়ের পক্ষ থেকে আমিই কথা বলছি। আমার বাবার কখনোই হৃদরোগ ছিলো না। আমরা কারাগারে যখন সাক্ষাত করেছি তখনো এমন কোন অসুস্থতার কথা তিনি বলেন নি”।
শাহাদত আলম ঝুনু রাজনীতির পাশাপাশি বগুড়ার একটি সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন। আশির দশকে ছাত্ররাজনীতি করার সময় থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
মি. চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “ঝুনু গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তেও আমার সাথে ফোনে কথা বলেছেন। সুস্থ সবল ও সজ্জন মানুষটা আটক হয়ে কারাগারে গেলো। সরকার তার লাশ উপহার দিলো। ঝুনুসহ চার জনই কারাগারে সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে,” বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হচ্ছেন। তার দাবি এসব হামলা ‘পরিকল্পিত’।
বগুড়া জেলা কারাগারের জেলা সুপার ফারুক আহমেদ বলছেন, যারা মারা গেছেন তারা বয়স্ক এবং তারা কারাগারে আসার আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন।
“তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। কারাগারে তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অবহেলা হয়নি। কেউ ডায়াবেটিস,কেউ হৃদরোগ কিংবা কেউ প্রেশারের রোগী ছিলেন আগে থেকেই। রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় হয়তো মানসিক চাপ বা হতাশায় অসুস্থতা বেড়ে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি.আহমেদ বলছেন কারাগারের ভেতরে কেউ অসুস্থ হলে সাথে সাথে তাকে কারা হাসপাতালে নেয়া হয় এবং চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলছেন কারাগারে হোক আর পুলিশ হেফাজতে হোক- একজন আটক ব্যক্তি যখন মারা যান, তখন তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
“রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে। আবার কারা কর্তৃপক্ষ যদি বলেন তারা আগেই গুরুতর অসুস্থ ছিলো তাহলে তো তাদের আগে থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু এসব ঘটনায় কী সেটি করা হয়েছে?,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. পান্না বলছেন আটকের সময়ই যদি একজন মানুষ খুব অসুস্থ থাকেন তাহলে সে অনুযায়ী পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ