১৫ বছরের অধিক একদলীয় শাসনের অবসানের পর বিএনপি’র সুযোগ এসেছে আবার একটি লেভেল প্লেয়িং কন্ডিশনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। খুব বেশি ভুল এবং নাটকীয় কোনো রাজনৈতিক পটপরিবর্তন না হলে, বাংলাদেশের দুটি বড় দলের একটি হিসাবে বিএনপি’র বড় সুযোগ আছে সরকার গঠন করার। কিন্তু কথা হলো বিএনপি কি সেই সুযোগটি দু’হাত ভরে নেবে নাকি স্বাধীনতার পর হতাশকারী মোটামুটি সব সরকারের লিস্ট আরেকটু লম্বা হবে?
বিএনপি’র সুযোগ আছে জনগণের দল হয়ে উঠার। তার আগে তাদের বুঝতে হবে এদেশের জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটা কী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নানা মত ও পথে বিভক্ত। সেজন্যই হয়ত ছোট একটি দেশে ৫০টির অধিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। তবে এদের প্রধান তিনটি উপধারা হলো ডানপন্থী, বামপন্থী এবং মধ্যপন্থী। এদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মূলত: মধ্যপন্থী । যদিও এদের একটি একটু বেশি বাম-ঘেঁষা এবং আরেকটি একটু ডান-ঘেঁষা। তবে মধ্যপন্থীদের এতো রাজনৈতিক সমর্থন আদতে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। চিরায়তকাল ধরেই এদেশের মানুষ উদারনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছে। কিছু রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য চরিতার্থ করার মানসে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক তত্ত্ব ও তথ্য সন্নিবেশ করে জনগণকে তাদের সাথে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছে কিন্তু পুরোপুরি সফল হয় নি। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও কখনো ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তেমন বড় কোনো অঘটন ঘটে নাই, বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংসতা ছাড়া।
গত সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি আন্দোলনে ছিলো অনেক বছর ধরে। যদিও দলটি সে অর্থে রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তির বিরুদ্ধে তেমন সফল হতে পারে নি। কিন্তু সরকারের শোষননীতির বিরুদ্ধে পাবলিক পারসেশন বা জনমত তৈরিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। তবুও নিজেদের যথোপযুক্ত বিকল্প হিসাবে দাঁড় করানোর ব্যর্থতায় আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণকে পাশে পায় নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নে দলীয় সংগঠন ও তার নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি এমন অভিযোগ আছে। তবে জুলাইয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকে বিএনপি নেতৃত্বের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত তাদের রাজনীতি ধীরে চলো নীতি, জনগণকে সম্পৃক্ত করে চলার আগ্রহ এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। এসময় দলটিতে অনেক বেশি সুসংহত ও আস্থাবান মনে হয়েছে।
দীর্ঘ আন্দোলনের পরিযাত্রায় বিএনপি’র ভোট ব্যাংক বা জনসমর্থন যে এখনো অটুট আছে, তার প্রধানতম কারণ সম্ভবত তাদের নীরব ভোটার। যারা হয়ত তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকদের মতো মাঠের রাজনীতিতে এতো বেশি সক্রিয় নন, তবে নীরবে সমর্থন দেবার কাজটি তারা করে গেছেন। সক্রিয় নেতাকর্মীরা জেল-জুলুম-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন সেটা অনস্বীকার্য তবে বিএনপি মোটা দাগে টিকে আছে সেইসব নীরব সাধারণ জনগণের সমর্থনে। তাছাড়া বেশকিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ সর্বস্বই মিথ্যা এটা বলা বাড়াবাড়ি হবে।
বিএনপি’র নতুন পথচলায় জনগণ হয়ত সেই আস্থার জায়গাটা দেখতে পেতে শুরু করেছিলো, যে তারা একটা পরমতসহিষ্ণু, ন্যায়পরায়ণ, গণতান্ত্রিক এবং মোটের উপর উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল পেতে যাচ্ছে। কিছু নেতাকর্মীর উছৃঙ্খল আচরনের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, পরিমিত বক্তব্যের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের কাছে শীর্ষ নেতৃত্বের বার্তা ছিলো স্পষ্ট। জাতিগত বিদ্বেষ, পাহাড়ে অশান্তি ও ধর্মীয় বিষয়ে তাদের অবস্থান ছিলো লক্ষণীয়ভাবে আশাব্যঞ্জক।
কিন্তু প্রত্যাশার বিপরীতে আশংকা হলো এতো তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও কিছু নেতাকর্মীর কার্যকলাপ ও শাস্তিপ্রাপ্ত নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে সরব উপস্থিতি প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিএনপি ঘরনার কিছু নেতা ও বুদ্ধিজীবী, যারা মূলত: বিগত সরকারের সময় দেশান্তরি ছিলো, তাদের প্রত্যাবর্তনে এক নতুন পরিস্থিতি সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এদেশের জনগণের প্রত্যাশিত পথেই বিএনপি তাদের পূর্বের রাজনৈতিক মিত্রদের সাথে দূরুত্ব বজায় রেখেছে। বিএনপি’র ভেতরে থাকা একটি গোষ্ঠী সবসময় ভোট-নিরাপত্তার অজুহাতে পূর্বে বিতর্কিত রাজনৈতিক শক্তির সাথে কোয়ালিশন করে ভোটে যেতে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো। কিন্তু সেই কৌশল যে ভুল ছিলো গত ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে তা বিএনপি’র উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
২০০৮ এ নিরষ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সুযোগ ছিলো আপামর জনগণের দল হিসেবে গড়ে উঠার এবং নতুন ধরনের রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠার। কিন্তু পরপর তিনটি একপাক্ষিক ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, নিজ দলে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব, দলীয় কার্যক্রমকে অল্পসংখ্যক নেতার ইচ্ছাধীন করে ফেলে আমলা-নির্ভর রাষ্ট্র গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কি নির্মম প্রতিদান পেলো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। এই পতনকে শুধুমাত্র বিরোধীদের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতীয়মান করে পার পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের দুটি দলেরই অনুতাপের বিষয়টি চোখে পড়ার মতো নয়। কট্টর সমর্থকগোষ্ঠী ছাড়া আপামর জনগণ বিষয়টি কীভাবে গ্রহণ করবে তা দেখার বিষয়। দল হিসেবে বিএনপি যদি এই সুযোগটি নিতে না পারে, তাহলে তৃতীয় কোনো দল আত্মপ্রকাশ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটি কতোটা কার্যকরী এবং সময়সাপেক্ষ হবে তা এক প্রশ্ন বটে। সেক্ষেত্রে জনগণের লিবারেল অংশটির উচিত বিএনপি বা সমমনা দলগুলোর উপর চাপ অব্যাহত রাখা যাতে উগ্রবাদী অংশ দ্বারা বিএনপি তার পথ না হারায়। কারণ রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব সবচেয়ে বেশি জরুরি।
দল হিসেবে বিএনপি’র আরো একটি বড় নেতৃত্বের জায়গায় হলো গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সহযোগী থাকা এবং একই সাথে নিজের উদারনৈতিক রাজনৈতিক ধারাটা প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপি ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অন্তত: দুইটি বড় দাবির বিপরীতে দাঁড়িয়েছে এবং আপেক্ষিকভাবেই বিএনপি’র অনড় অবস্থানের কারণে ছাত্র-নেতৃত্ব তাদের দাবি স্থগিত করেছেন, কিন্তু সরে এসেছেন কিনা তা সময় বলবে। এক্ষেত্রে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও মহাসচিবের যুগল-নেতৃত্ব কেমন দাঁড়াবে তা সময় বলে দেবে। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার প্রশ্নে ঐক্যমত থাকলেও, দল হিসেবে আওয়ামী লীগে নিষিদ্ধে বিএনপি’র অবস্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মাঝে আশংকা ও অনিরাপত্তার বোধ তৈরি করেছে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইন-শৃঙ্খলা, দ্রর্বমূল্য, প্রশাসনিক সংস্কার, মব জাস্টিস, অতীতে নিষিদ্ধ রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনগুলোর পুনরুত্থাপনসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এর সবগুলো যে সরকার ভালোভাবে সামলাতে পারছেন তা নয়। তাই দল হিসেবে বিএনপি’র উচিত সর্বাত্নকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করা। দখলদারী, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া, জনগণের দল হয়ে উঠার চেষ্টা করা, এই সরকার যেন ব্যর্থ না হয় সেটি নিশ্চিত করে, নতুন ধারার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গঠনে নেতৃত্ব দেওয়া।
বিগত কয়েক মাসের নেতৃত্ব ও আলোচনায় এটি স্পষ্ট, ক্ষমতার মসনদের ভেতর এবং বাইরে থেকে রাজনীতি দেখার অভিজ্ঞতায় তাদের নেতা তারেক রহমান তার নেতৃত্বের দ্বিতীয় সংস্করণে উত্তীর্ণ হয়েছেন, যেটি তারেক রহমান ২.০ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এখন তারেক রহমান ২.০ সংস্করণে বাস্তবিক অর্থেই গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত, সুশাসনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয় কিনা-সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যেমন ব্যর্থ হবার সুযোগ নেই, ঠিক তেমনি তারেক রহমান ২.০ সংস্করণের বিএনপি’র দল হিসেবে ব্যর্থ হবার সুযোগ নেই।
আপনার মতামত জানানঃ