সন্ত্রাস দমন, এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হয়েছিল পুলিশ ফাঁড়ি। সেই ফাঁড়িই এখন সন্ত্রাসীর দখলে। পুলিশ ফাঁড়িতে বসে চালানো হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এমন ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ থানাধীন নাছিয়াঘোনা এলাকায়।
সেখানকার আলোচিত সন্ত্রাসী নুরু আলম নুরু ও তাঁর বাহিনী এই পুলিশ ফাঁড়ি দখল করেছে। একসময় আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী নুরু এখন যুবদল কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। দলের কর্মসূচিতেও তাঁকে দেখা যায়। পুলিশ বলছে, তাদের অবস্থা এখন দুর্বল এবং সেখানে যাতায়াতের অসুবিধার কারণে ওই ফাঁড়ি উদ্ধার করতে পারছে না তারা।
পাহাড় কাটা, সরকারি পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি, অস্ত্রবাজি, মাদক কারবার, জুয়া, জায়গা দখল, অস্ত্রের ব্যবসা, অপহরণসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এক দশক ধরে আলোচিত নুরু। পুলিশের তালিকাভুক্ত আসামি তিনি। ২৫টি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক দশক আগে সাবেক কাউন্সিলর ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের নেতা জহিরুল আলম জসিমের হাত ধরে নুরু পাহাড় কাটার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এরপর জহিরুল আলমের সঙ্গ ছেড়ে হয়ে ওঠেন আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেনের অনুসারী।
নুরুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠার পর ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর নাছিয়াঘোনা এলাকায় একটি বড় অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। গোয়েন্দা ও পুলিশের শতাধিক সদস্য দুই দিন ধরে সেখানে অভিযান চালান। ওই সময় আস্তানা ধ্বংসসহ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়। ওই অভিযানে পুলিশের ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছিলেন। ওই সময় গা ঢাকা দেন নুরু। এরপর ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি নুরুকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জামিনে বেরিয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ থানার পাহাড়বেষ্টিত পূর্ব ফিরোজশাহ ১ নম্বর ঝিল, বেলতলীঘোনা ও নাছিয়াঘোনা এলাকায় অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। এলাকায় কয়েক শ বাড়িঘর রয়েছে। নাছিয়াঘোনায় নুরুর রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। পাহাড় কেটে বিভিন্ন স্থপনাও নির্মাণ করেছেন তিনি। এলাকাটি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। পাহাড়বেষ্টিত এলাকায় নুরুর ‘রাজত্ব’ চলে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
পুলিশ সূত্র বলছে, তাদের ছোট কোনো দলের পক্ষে সেখানে গিয়ে অভিযান চালানো দুরূহ ও নিরাপত্তাহীনতা—দুটোই রয়েছে। তবে এরপরও ২০২১ সালে ওই এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল পুলিশ। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। এলাকাবাসী বলছেন, ওই সময় নুরু ও তাঁর সন্ত্রাসীরা ওই ফাঁড়িতে হামলা চালান। এর পর থেকে ফাঁড়িতে পুলিশ নেই। ফাঁড়ি দখল করে সেখানে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন নুরু। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পাহাড়তলী জোনের সহকারী কমিশনার মো. মাঈনুর রহমান বলেন, ‘এলাকাটিতে নিরাপত্তার জন্য আমরা সেখানে একটি ফাঁড়ি স্থাপন করেছিলাম। কিন্তু সেখানে পুলিশের যাতায়াত, নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যা ছিল। সম্প্রতি সরকারের পটপরিবর্তনের সময় নিরাপত্তার কারণে পুলিশ সদস্যরা ফাঁড়ি থেকে চলে আসেন। পরে শুনেছি নুরুর লোকজন নাকি সেখানে থাকা পুলিশ ফাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে।’
আর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার হোছাইন মোহাম্মদ কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আপাতত সেখানে আমাদের কোনো ফাঁড়ি নেই।’
এলাকাবাসীর অভিযোগ, আকবরশাহ থানার স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মো. হাসান মাহমুদের ছত্রচ্ছায়ায় নুরু তাঁর অপরাধের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই অভিযোগের বিষয়ে হাসান মাহমুদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সন্ত্রাসীকে আমি কিংবা আমার দল কেন, কোনো সংগঠনই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। তাঁকে (নুরু) আমি চিনলেও এ ধরনের অভিযোগ মিথ্যা।’
দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে নাছিয়াঘোনা এলাকায় অভিযান চালানো কঠিন এ কথা স্বীকার করেছেন পুলিশের পাহাড়তলী জোনের সহকারী কমিশনার মো. মাঈনুর রহমান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সন্ত্রাসী নুরু যতই রাজত্ব করুক পুলিশের জালে তাকে পড়তে হবেই। এখন সময় খারাপ হওয়ার কারণে পুলিশ সেখানে অভিযান চালাতে পারছে না। নুরুর আস্তানায় যেতে হলে পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। বড় বড় তিনটি পাহাড় পেরিয়ে তারপর তার আস্তানায় পৌঁছা যায়।’
আপনার মতামত জানানঃ