বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে তার দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করার পর দল ও দলের বাইরে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দলটির অনেকের ধারণা সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য ‘কোনো একটি পক্ষ সক্রিয়’ হয়ে কাজ করছে।
দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে বলেই নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টার আশঙ্কা আছে বলে তারা মনে করেন। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও কারও বক্তব্যেও তারা সেই ইঙ্গিত পাচ্ছেন।
পাশাপাশি সম্প্রতি ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনা নিয়ে বিএনপির ভূমিকা’ সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতার মন্তব্য নিয়েও নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে দলটির ভেতরে।
তবে দলটির মুখপাত্র ও জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলছেন, জরুরি সংস্কার ও নির্বাচনি প্রস্তুতি একই সাথে চলতে পারে বলে তারা মনে করেন। একই সাথে ‘নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে’ বিএনপির কোন ভূমিকা নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
“কিন্তু বিএনপি মনে করছে পতিত স্বৈরাচারের বিভিন্ন ফ্যাক্টর বিভিন্ন ভাবে নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য সরকারকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে। এটিই ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ।
প্রসঙ্গত, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সরকার গঠিত অনেকগুলো কমিশন এখন কাজ করছে। এর মধ্যে সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যও উদ্যোগ নিয়েছে।
যদিও সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক সাক্ষাতৎকারে সামনের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ প্রশ্নে বলেছেন, “বিএনপি এটা করেছে, বলেছে সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে”।
যদিও বিএনপি মহাসচিব আজ ফেনীকে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন ‘আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ নাকি আমরা দিচ্ছি। এই কথাটি সঠিক না’।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেয়া, এমনকি রাজনীতি করারও সুযোগ দেয়ার ঘোর বিরোধী। এর আগে সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়েও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলো বিএনপি।
ফলে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর কথা বলেও সেখান থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের। অন্যদিকে সংবিধান সংস্কারে একটি কমিশন কাজ করলেও বিএনপি মনে করে এটি বাস্তবায়ন করতে পারে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির আশাহত হওয়ার মূল কারণ হলো নির্বাচন বিলম্বিত হলে বিএনপির ‘বর্তমান জনপ্রিয়তা’ এবং ‘পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ’ একই ধরনের নাও থাকতে পারে। সে কারণেই ‘নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা’ তাদের কাছে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা ও জনসম্পৃক্তি’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালায় মঙ্গলবার ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রায়ই বলি ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। আপনারা নিশ্চয়ই গত কয়েক দিনের পত্র-পত্রিকার খবর থেকে বুঝতে পারছেন। কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। কাজেই জনগণকে সচেতন করতে হবে, জনগণকে পাশে রাখতে হবে, জনগণের পাশে থাকতে হবে।’
একই সঙ্গে তিনি বলেন গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে ভোটের মাধ্যমে জবাবদিহি তৈরি হয়। “এই ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য অসংখ্য নেতা-কর্মী গুম ও খুন হয়েছেন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যেকোনো মূল্যে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।“
মূলত তার এ বক্তব্যের পর ‘কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে’ -মন্তব্যটি আলোচনায় চলে আসে। মি. রহমান ও তার দলের নেতারা গত কিছুদিন ধরেই সরকারকে সহযোগিতার পাশাপাশি ‘দ্রুত নির্বাচন’ দাবি করে আসছেন।
যদিও সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনের আগে সংস্কারের কথা বলছেন এবং একই সাথে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন যা দলটির নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
‘নির্বাচনের সময়সীমা ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ইস্যুতে’ বেশ কিছুদিন করে সরকার পক্ষ ও বিএনপির বক্তব্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো।
বিএনপি সবসময় জরুরি সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করে আসলেও এর মধ্যে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার অন্তর্বর্তী সরকারের সময়সীমা চার বছরের কম হবে বলে একটি ধারণা দিয়েছেন।
আবার ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্যা হিন্দুর সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়টির দায় বিএনপির ওপর দিয়েছেন বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্যা হিন্দুকে বলেছেন, “এটা ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি এটা করেছে, বলেছে সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা ইতিমধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করব না”।
তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আপনার কোনো আপত্তি নেই—সে প্রশ্নের জবাবে মি. ইউনূস বলেন, “কোনো একটি দল বা আরেকটি দলকে বেছে নেওয়ার জন্য আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি রাজনীতিকদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করছি”।
মঙ্গলবার সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেছেন , “ছেলেদের রক্তের ওপর পা রেখে দিল্লিকে কিবলা বানিয়ে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জনগণের মুক্তির নিয়তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আওয়ামী পুনর্বাসনের জন্য যারা উদ্যোগ নেবে, তাদেরকে ইতিহাস গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে”।
এর আগে সোমবার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘আমরা সরকারের পক্ষ থেকে যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলি, তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বক্তৃতায় সেটি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে’। জনমনে ধারণা আছে যে তারা এগুলো হয়তো বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলে থাকতে পারেন। তবে আজ বুধবার হাসনাত আব্দুল্লাহ বিষয়টি নিয়ে এক দীর্ঘ পোস্ট করেছেন সামাজিক মাধ্যমে।
সেই পোস্টের এক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন ‘বিএনপি, জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী কোনো দলের সাথেই শিক্ষার্থীদের ভেদাভেদ নেই। তাছাড়া, এই গণঅভ্যুত্থানের পরে একটি ব্যাপার দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে যে বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি কখনোই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। সুতরাং আমরা বিভাজনের বদলে ঐক্য চাই। অপশাসনের বদলে সুশাসন চাই’।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য ‘পতিত স্বৈরাচার’ এর নানা ফ্যাক্টর দেশে বিদেশে নানাভাবে চেষ্টা করছে এবং এটিকেই তার দল ‘ষড়যন্ত্র’ মনে করছে।
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে প্রধান উপদেষ্টা যে মন্তব্য করেছেন, সে প্রসঙ্গে মি. আহমেদ বলেছেন, গণহত্যাসহ যেসব অপরাধ আওয়ামী লীগ ও এর নেতা শেখ হাসিনা করেছেন সেজন্য তাদের বিচার হতে হবে।
তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধ্যাদেশের যে সংশোধনী আনা হচ্ছে তাতে এসব অপরাধে কোন ব্যক্তি বা দল দোষী হলে নির্বাচনে তাদের অংশ নেয়ার সুযোগ বন্ধ করার বিষয়টি তো আইনের বিষয়।
“আমরা গণহত্যাসহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চাই। এ নিয়ে তো বিএনপির ওপর দোষ চাপানোর কিছু নেই। আমরা মনে করি আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি জনগণ ও আন্দোলনে যারা যারা ছিলেন তারা কী চান সেটাও দেখতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বিএনপিকে ইঙ্গিত করে যেসব বক্তব্য দিয়েছে তাতে করে তাদের সাথে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে মি. আহমেদ বলেন, “আমি মনে করি ছাত্রনেতাদেরও তাদের বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ করা দরকার, যাতে করে বিএনপিসহ যারাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে তাদের মধ্যে কোন ভুল বুঝাবুঝি তৈরির সুযোগ না হয়”।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফেনীতে এক অনুষ্ঠানে আজ বলেছেন, “আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ নাকি আমরা দিচ্ছি। এই কথাটি সঠিক না। আমরা বলেছি, আওয়ামী লীগ একটা রাজনৈতিক দল। কে রাজনীতি করবে, কে রাজনীতি করবে না, তা নির্ধারণ করবে জনগণ। সুতরাং, এখানে কোনও ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নাই।”
“আমরা কখনোই কোনও দলকে নির্বাচন করতে মানা করিনি। কিন্তু যারা হত্যা করেছে, মানুষ খুন করেছে, অন্যায় করেছে, দেশের সম্পদ নষ্ট করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদেরকে অবশ্যই, হাসিনাসহ, সকলকে এনে বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে যে তারা কাকে রাজনীতি করতে দিবেন, কাকে দিবেন না,” বলছিলেন মি. আলমগীর।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান অবশ্য বলছেন, বিএনপির আকাঙ্ক্ষা ছিলো দ্রুত নির্বাচন হলে ভোটের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় যাবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সরকার একটু বেশি সময় থাকতে চাইছে আর ছাত্র সংগঠকরা ভোটের আগেই ব্যাপক সংস্কার চাইছেন।
“তাছাড়া বিএনপির মধ্যে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ারও ভয় থাকতে পারে। তারা ভাবতে পারে যে এখন তাদের যে জনপ্রিয়তা সেটি হ্রাস পেতে পারে। সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে কোন কোন পক্ষ নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইতে পারে। আমার মনে হয় এই আশঙ্কা থেকেই তারা ষড়যন্ত্রের কথা বলছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, একদিকে বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকরা চাইছেন তাদের চিন্তা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। সেই সাথে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে সাথে নিয়েই চলতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার।
আপনার মতামত জানানঃ