“বগুড়ার ধুনটের ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের শহরাবাড়ী। সেখানে যমুনা নদীতে বিকট শব্দে চলছে ড্রেজার মেশিন। বাল্কহেডে (বালু বহনকারী নৌকা) বালু ভরে এনে রাখা হচ্ছে নদীর তীরে। রাতদিন ৫০ বাল্কহেডের বিরামহীন ছোটাছুটিতে অন্যরকম এক কর্মযজ্ঞ। নদী ফোকলা করার পুরো প্রক্রিয়া চলছে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। আগে এ কাজের নেতৃত্বে ছিল যুবলীগ। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় বিএনপি ও যুবদল নেতাকর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যমুনার ভাঙনকবলিত ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের চৌবেড় মৌজার প্রায় ৩৬ একর সম্পত্তি সরকারিভাবে বালুমহাল ঘোষণা করা হয়। বিআইডব্লিউটিএ থেকে নকশা অনুমোদনের পর গত বছরের ২০ মে ৫৫ লাখ ঘনফুট বালু তোলার জন্য দরপত্র আহ্বান করে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। ধুনট যুবলীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক গোসাইবাড়ী এলাকার বেলাল হোসেন ৫৫ লাখ টাকায় এই বালুমহালের ইজারা নেন। বাংলা ১৪৩১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত এক বছর এই মহাল থেকে বালু তোলার অনুমতি রয়েছে। শুরুর দিকে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও কিছুদিন পর ইজারাদার শর্ত ভাঙতে থাকেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট করে দেওয়া চৌবেড় মৌজা থেকে বালু না তুলে ৪ কিলোমিটার দূরের (পূর্বপাশে) আটটি পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। উত্তোলন করা বালু স্থানীয় প্রশাসন মাপার পর বিক্রি করার শর্ত থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। রাতদিন নদীপাড়ে শত শত ট্রাকে করে বিক্রি করা হচ্ছে বালু। বাল্কহেডে করে নদীপথে সেই বালু পাঠানো হচ্ছে জামালপুরের তারাকান্দি, সরিষাবাড়ী, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও সিরাজগঞ্জের ঢেকুরিয়া এলাকায়।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বালুমহাল নিজেদের কবজায় রাখতে ইজারাদার যুবলীগ নেতা বেলাল হোসেনের সঙ্গে হাত মেলান বিএনপি ও যুবদল নেতাকর্মী।
এদের মধ্যে রয়েছেন ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক, বিএনপি সমর্থক মোহাম্মদ আলী, একই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সমর্থক বেলাল হোসেন বাবু, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক রাশেদুজ্জামান উজ্জ্বল, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম টগর, উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হালিম, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক বিপ্লব হোসেন, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক স্বপন মাহমুদ। রাজনীতির মাঠে একে অপরের শক্র হলেও বালু লোপাটে তারা হয়েছেন ‘বন্ধু’। নদীর ছয়টি মৌজা অবৈধ দখলে নিয়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০টি ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে।
পরে বাল্কহেডের মাধ্যমে নদীর তীরে রাখা হচ্ছে বালু। অভিযোগ রয়েছে, নদীর তলদেশসহ পাশের বন্যানিয়ন্ত্রণ স্পার ও বাঁধের পাশ থেকে এখন পর্যন্ত তিন কোটি ঘনফুট বালু তুলে বিক্রি করা হয়েছে। বালু তোলার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বৈশাখী রাধানগর, শহরাবাড়ী, শিমুলবাড়ী, বানিয়াজান, কয়াগাড়ি, ভান্ডারবাড়ী ও ভূতবাড়ী গ্রাম।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাতদিন ড্রেজার মেশিনের বিকট শব্দে প্রকম্পিত আশপাশের এলাকা। যমুনা নদীতে হরদম যাতায়াত করছে ৫০টি বালুবোঝাই বাল্কহেড। যেগুলো শহরাবাড়ী এলাকার মধ্যে নদীপাড়ের ৮টি পয়েন্টে ভিড়িয়ে আলাদা করে বালু নামিয়ে স্তূপ করা হচ্ছে।
বাল্কহেডের চালক ও শ্রমিকদের কাছে প্রতিদিন কত ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ছোট বাল্কহেডে আড়াই হাজার আর বড় বাল্কহেডে ৫ হাজার ঘনফুট বালু বহন করা হচ্ছে। তাদের তথ্য অনুসারে ৫০টি বাল্কহেডে গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লাখ ঘনফুট বালু বহন করা হয়। এই হিসাবে গত দেড় মাসে বালু উঠেছে সোয়া কোটি সিএফটি। আর ছয় মাসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৪ কোটি সিএফটি। এক সিএফটি বালুর ওজন পাঁচ কেজি হলে, এ পর্যন্ত নদী থেকে ২২ কোটি ৫০ লাখ কেজি বালু তুলে অবৈধভাবে বিক্রি হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে তাতে ইজারা মেয়াদের বাকি ছয় মাসে অন্তত ১০ কোটি ঘনফুট বালু তুলে নেওয়া হতে পারে। অর্থাৎ ৫০ লাখ সিএফটির অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে প্রায় ১৫ কোটি সিএফটি বালু তোলার টার্গেট নিয়েছে চক্রের সদস্যরা। বর্তমান বাজারদরে প্রতি সিএফটি ৬ টাকা হারে বালুর দাম দাঁড়ায় ৭৫ কোটি টাকা।
এভাবে বালু তোলায় যমুনা নদীর ভাঙন প্রতিরোধে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বানিয়াজান স্পার ও ৪০ কোটি টাকার শহরাবাড়ী স্পার, ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত যমুনা নদীর ডানতীর সংরক্ষণ প্রকল্প (রিভেটমেন্ট) ছাড়াও সে এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, তীরবর্তী ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কোটি কোটি টাকার স্থাপনা হুমকির মুখে পড়েছে।
বৈশাখী চরের মাসুদ রানা, গোলাম রব্বানী ও রহিমা বেগম জানান, যমুনা নদীর ভাঙনে এক সময় চরের বৈশাখী গ্রাম নদীতে বিলীন হয়েছিল। প্রায় ১৫ বছর আগে চর জেগে ওঠায় ফের বৈশাখী গ্রামের মানুষ চরে বসতি গড়ে তোলে। নিঃস্ব মানুষ জমি ফিরে পেয়ে চাষাবাদ শুরু করেছিল। তবে বালুদস্যুরা প্রতিদিন ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলায় এখন চরটি নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে।
বিএনপির অন্য একটি গ্রুপ অবৈধভাবে বালু তোলার বিরোধিতা করছে। তা নিশ্চিত হওয়া গেছে উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি সাইফুল ইসলাম তালুকদার ভেটুর কথায়। তিনি বলেন, ইজারার শর্ত ভেঙে যুবলীগ এবং বিএনপির একটি অংশ নদীর এই সর্বনাশ করছে। বালু তোলা বন্ধের দাবিতে এলাকাবাসী গণস্বাক্ষর দিয়ে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে। তিনি দাবি করেন, ৮টি পয়েন্টের মধ্যে বিএনপি নেতা মাহমুদুল হকের একটি পয়েন্টেই রয়েছে ১ কোটি ঘনফুট বালু।
এলাকাবাসীর পক্ষে সাবেক ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম বলেন, যুবলীগ নেতা বেলাল হোসেন বালুমহাল ইজারা নেওয়ার কিছুদিন পরই মূল স্থান থেকে সরে নদীর ৪ কিলোমিটার ভাটিতে বৈশাখী, শহরাবাড়ি ও শিমুলবাড়ির ৮টি মৌজা টার্গেট করেন। পরে গ্রামবাসী ভাঙনের শঙ্কায় যমুনার পাড়ে মানববন্ধন করেন। তারপরও স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। ইজারার শর্তে অন্য কাউকে সাব-লিজ দেওয়া যাবে না– এমন কথা উল্লেখ থাকলেও যুবলীগ নেতা বেলাল হোসেন বিএনপি নেতাদের কাছে সাব-লিজ দিয়েছেন। আর অবৈধভাবে বালু তোলা, বিক্রি এবং সাব-লিজ দেওয়ার বিষয়ে ধুনটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হলেও বিশেষ কারণে তিনি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
ইজারাদার যুবলীগ নেতা বেলাল হোসেন বলেন, আমি নির্ধারিত সীমানার মধ্যেই বালু তুলছি। আমার সঙ্গে বিএনপির একটি গ্রুপ যৌথভাবে ব্যবসা করছে। তাদের দলেরই আরেকটি অংশ এ ব্যবসার বিরোধিতা করছে। এরাই বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষকে উস্কে দিয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করাচ্ছে।
বিএনপির নেতা মাহমুদুল হক বলেন, অনেক আগে থেকেই আমি যুবলীগ নেতা বেলাল হোসেনের সঙ্গে যৌথ বালু ব্যবসা করি। বালুমহালে আমার ২০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক রাশেদুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, বালুমহালে সিরাজগঞ্জের সাত্তার নামের এক ব্যক্তির ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল। আমি সেটা কিনে নিয়ে অংশীদার হয়েছি।
ধুনট উপজেলা বিএনপির সভাপতি তৌহিদুল আলম মামুন বলেন, আমাদের কোনো নেতাকর্মী এই অবৈধ কাজে জড়িয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা যমুনার তীর ভেঙে বালুমহাল চাই না।
ধুনটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক খান বলেন, বালুমহাল ইজারাদারের সঙ্গে গ্রামবাসীর ঝামেলা হয়েছিল। আমি সেনাবাহিনীর সহায়তায় ঘটনাস্থলে গিয়ে ইজারার শর্ত অনুযায়ী শুধু চৌবেড় মৌজা থেকেই বালু তুলতে নির্দেশ দিয়েছি। এখন তারা নির্দেশনা অমান্য করলে ব্যবস্থা নেব।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী লিটন আলী জানান, নির্ধারিত বালুমহাল দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। পাউবো শুধু নদী ও বাঁধের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি দেখে। তিনি স্বীকার করেন, মূল স্থানে বালু না তুলে অন্য স্থানে ড্রেজিং করলে এর প্রভাব নদীর তীরবর্তী এলাকায় পড়বে।
আপনার মতামত জানানঃ