ঘুষ ছাড়া সরকারি দপ্তরে কোনো কাজ হয় না। অথচ নানা সেবা পেতে সরকারি নানা কার্যালয়ে যেতেই হয়। একসময় বলা হতো সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ালেই দুর্নীতি কমবে। তারপর বেতন বাড়ানো হলো। এখন বরং বেতন বা পদমর্যাদা অনুযায়ী ঘুষের হারও বেড়েছে।
অবশ্য সরকারি কোনো ন্যায্য সেবা পেতে ঘুষ দেওয়াকে একটি নাম দিয়েছিলেন প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একে বলেছিলেন ‘স্পিড মানি’। এই স্পিড মানির পরিমাণ যে কত, তার উদাহরণ হচ্ছে সাবেক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ও এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার বিপুল সম্পদের বিবরণ।
সেবা দেয়, এমন সরকারি কার্যালয়ে ঘুষের নানা রকমফের আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে একটি চক্র। সেই চক্রে শামিল থাকেন প্রায় সবাই। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। সেই চক্রটি এতটাই শক্তিশালী যে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে ঘুষ চাওয়াকেও স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়। এ রকম কিছু উদাহরণ দিয়েছেন বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। নতুন দায়িত্বে আসার আগে তিনি সিনিয়র সচিব হয়ে অবসর নিয়েছিলেন। দীর্ঘ বছর তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে ছিলেন।
আইনসচিবও হয়েছিলেন। তিনি সম্প্রতি ‘বিচার ও প্রশাসন: ভেতর থেকে দেখা’ নামে একটি বই লিখেছেন। সেই বই থেকে তুলে দেওয়া হলো দুর্নীতির দুটি ঘটনার বিবরণ। সঙ্গে আছে একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রীর অজানা কাহিনি।
কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘২০০৫ সালে আমি আইন মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব। এর কয়েক বছর আগে থেকেই ইস্কাটন গার্ডেনের একটি সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস করতাম। ২০০৫ সালে কাকরাইল সার্কিট হাউসের চারটি অংশের একটি অংশে বরাদ্দ পেলাম। বর্তমানে সেটি ২২ তলাবিশিষ্ট জাস্টিস টাওয়ার। নতুন এ বিশাল বাড়িতে মাসে ৪০০ বা ৫০০ টাকা করে বিদ্যুৎ বিল পাচ্ছিলাম। খুশিই ছিলাম। কারণ, বিদ্যুৎ বিল এত বড় বাড়িতে অনেক কম। চারটি বাড়ির একটি বাড়ির আবাসিক কর্মকর্তা (সচিব) জানালেন যে এই বাড়িগুলোর এটিই সুবিধা, বিল নির্ধারিত এবং অল্প। নিয়মিত বিল পরিশোধ করে যাচ্ছিলাম।’
কম বিল দেওয়ার নেপথ্যে একটি কারণ অবশ্য ছিল। আর সে ক্ষেত্রেই নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।
তিনি লিখেছেন, ‘কয়েক মাস পর একজন মিটার রিডার এসে পরিচয় দিয়ে বললেন প্রতি মাসে তাকে ৫০০ টাকা করে দিলে বিদ্যুৎ বিল মাত্র নির্ধারিত ৩০০ বা ৪০০ টাকার অধিক হবে না। যত ইচ্ছা প্রয়োজন বিদ্যুৎ আমি খরচ করতে পারব। অনেকটা আহাম্মক হয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম কীভাবে সেটা সম্ভব। তিনি একটি শব্দ ব্যবহার করলেন ‘এস্টিমেটেড বিল’।
প্রতি মাসে তিনি এস্টিমেটেড বিল দিয়ে যাবেন। আমি বললাম, যা বিল হয় তাই দেব, কোনো বাড়তি টাকাপয়সা দেব না। অনেকটা রাগ হয়ে তাকে বিদায় করলাম। এর পরের মাসে বিল হলো ৩০০০ টাকা। তার পরের মাসে ৫০০০ টাকা। বিলগুলো অত্যধিক হলেও বুঝে না বুঝে যথারীতি পরিশোধ করলাম।’
বিদ্যুৎ বিলের সমস্যার শেষ এখানেই নয়। বরং বাড়ল বলা চলে। কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘তার পরের মাসে বিল এল ৩৬ হাজার টাকা। আমার মাসিক বেতন তখন সাকল্যে ২৫ হাজার টাকা। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। স্বাভাবিক বিল বড়জোর মাসে ১২০০ টাকা হতে পারে। বুঝলাম মিটার রিডার সাহেব এই কর্মটি করছেন। আমি ৩৬ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করলাম না। দৌড়ে সচিবালয়ের পাশেই ডেসার অফিসে গিয়ে সরাসরি চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। চেয়ারম্যান মহোদয় দ্রুত খোঁজখবর নিয়ে জানালেন যে বহু বছর আগে থেকেই ওই সার্কিট হাউসের প্রতিটি কোয়ার্টারকেই এস্টিমেডেট বিল দেওয়া হচ্ছে।
আমি আমার লোকজন এনে মিটার পরীক্ষা করে দেখলাম। মিটার সঠিক এবং চালু আছে। ডেসার লোকজনও এসে দেখলেন মিটার সঠিক এবং চালু আছে। আমার মিটারে বকেয়া বিলের পরিমাণ কয়েক লাখ টাকা হবে। চেয়ারম্যান মহোদয়কে বললাম ২০–২৫ বছর আগে থেকে হওয়া বকেয়া বিল আমাকে কি একাই বহন করতে হবে। আমি একটু কঠোর হয়ে বললাম, বিষয়টি অবিলম্বে সমাধান করে দিন। নচেৎ দুদক বা আদালতের শরণাপন্ন হব। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন পরদিনই এসে আগের মিটার সরিয়ে জিরো রিডিং দেখিয়ে একটি নতুন মিটার প্রতিস্থাপন করলেন। আমার বিল এরপর থেকে শীতকাল–গ্রীষ্মকাল ভেদে ৮০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা হতো। যা–ই হোক পরাক্রমশালী মিটার রিডারের রাহু থেকে আমার মুক্তি ঘটেছিল।’
সমস্যা তাতেও পুরোপুরি কাটল না। কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাষায়, ‘রাহুর প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্তি ঘটল না। ২০০৭ সাল। পরিকল্পনা কমিশনের সভা শেষ করে মন্ত্রণালয়ে ফিরছিলাম। সে সময় আমি সচিব। মোবাইলে কল পেলাম। মেজো মেয়ে কাকরাইলের বাসা থেকে ফোন করেছে। আমার দায়িত্বহীনতার জন্য খুবই ক্ষুব্ধ। জানাল, আমি বিদ্যুৎ বিল নিয়মিত পরিশোধ না করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট এসে বাসার বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। মেয়েকে বললাম, মা, আমি দায়িত্বহীন নই। প্রতিটি বিদ্যুৎ বিল আমি সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করে দিই। আমার নথিতে প্রমাণ রয়েছে। কন্যা আমাকে বিশ্বাস না করে ম্যাজিস্ট্রেটকেই বিশ্বাস করতে চাইল।
‘তার যুক্তি, ম্যাজিস্ট্রেট কখনো অন্যায় করতে পারে না। কার্যালয়ে ফিরে আমি ডেসার চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানালাম। বললাম, আমি যে নিয়মিত বিল পরিশোধ করে থাকি তার সকল প্রমাণ আমার কাছে আছে। অবিলম্বে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলুন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রমাণ দেখতে। বিদ্যুৎ–সংযোগ যদি অবিলম্বে পুনঃস্থাপন করা না হয় আমি ম্যাজিস্ট্রেটসহ আপনার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে বাধ্য হব।
অতিশয় ভদ্র সেই ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ চার-ছয় মাস নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করেন। এরপর ভাড়া পরিশোধ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে তিনি একটি রাজনৈতিক দল থেকে উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ভাড়া পরিশোধ করার আর প্রয়োজনই থাকে না।
ম্যাজিস্ট্রেট আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলেন না। তার আগেই বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ–সংযোগ পুনঃস্থাপন করে দেন। অপরাহ্ণে ঘরে ফিরে ফাইল কেবিনেট থেকে কোর্ট ফাইল বের করে হালনাগাদ পরিশোধিত বিলের সকল কপি কন্যাকে দেখিয়ে তার হারানো বিশ্বাস ফিরে পেলাম। আমি বুঝলাম, এটি হয়তো সেই ক্ষুব্ধ মহাপরাক্রমশালী মিটার রিডার বা তার সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ হয়ে থাকবে। বিষয়টির অবতারণা করলাম এ কারণে যে, সরকারি পরিষেবা আমরা সঠিক অর্থের বিনিময়ে পেতে চাই। কিন্তু দুষ্টু চক্রের কারণে সদিচ্ছা থাকলেও কীভাবে আমরা বিড়ম্বনার শিকার হয়ে থাকি, তার একটি ধারণা দেওয়ার জন্য।’
আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাঁর বড় ভাই কাজী ওবায়দুল আউয়াল ১৯৯৮ সালে পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান প্রকৌশলী পদে ছিলেন। উত্তরা মডেল টাউনে রাজউক থেকে পাওয়া প্লটে তিনি একটি দোতলা বাড়ি করছিলেন। সেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে একজন ক্যাসিও মাস্টার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শোরুম পরিচালনা করতেন। এ নিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘অতিশয় ভদ্র সেই ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ চার-ছয় মাস নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করেন। এরপর ভাড়া পরিশোধ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে তিনি একটি রাজনৈতিক দল থেকে উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ভাড়া পরিশোধ করার আর প্রয়োজনই থাকে না। ভাগ্য আমাদের প্রসন্ন ছিল। তিনি তখন সংসদে বিরোধীদলীয় এমপি। আমার নিরীহ অসহায় ভাই আমার পরামর্শ চাইলেন।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল এরপর লিখেছেন, ‘পুলিশ বিভাগের এক বন্ধু জনাব ফণীভূষণ চৌধুরীকে জানিয়ে সাহায্য চাইলাম। তিনি সে সময় ঢাকার সিআইডি কার্যালয়ের সিনিয়র এসপি। ১৪ মাসের ভাড়া বকেয়া পড়ে ছিল। বড় ভাইয়ের পক্ষ হয়ে বললাম বকেয়া চাই না, ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করুন। বাবা ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলাও। বন্ধু ফণীভূষণ চৌধুরী দু-সপ্তাহের মধ্যে অবৈধ ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করে আমাদের পরিত্রাণ করলেন।’
ঘটনার শেষ অবশ্য তাতেও হলো না। দেখা দিয়েছিল নতুন বিপত্তি। কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘কয়েক দিন বাদেই ওয়াসার লোক এসে পানির লাইন কেটে দিল। কারণ দু-বছরের বিল বকেয়া। বিদ্যুতের লোক এসে বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দিল। কারণ দু-বছরের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। প্রবল পরাক্রমশালী সরকারি ইউটিলিটি সার্ভিসের সেই কনিষ্ঠ কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বিনয়ের সঙ্গে বড় ভাই জিজ্ঞেস করলেন, দু-বছর পরে কেন! আপনারা তো অনেক আগেই এসে এসব সংযোগ কেটে দিলে আমি বেঁচে যেতাম। তাঁরা ধমকের সুরে বললেন, সংযোগ কখন কাটা হবে, সেটি আপনার বিষয় নয়, আমাদের বিষয়। জনগণ এবার বুঝুন এ দেশে আমলারা কীভাবে সরকারি রাজস্ব নিজেরা চুরি করে নিয়ে সর্বসাধারণের ঘাড়ের ওপর করে বোঝা চাপিয়ে দেয়।’
সবশেষে কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘সেই সম্মানিত ভাড়াটিয়া ভদ্রলোক পরবর্তীতে বিএনপির শাসনামলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিশেষ এলিট ফোর্স র্যাব গঠনের জন্য আইন লাগবে। আইন মন্ত্রণালয়ে এসে মন্ত্রী মওদুদ আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। আমি সে সময় সেখানে বসা। কোন আইনে কীভাবে র্যাব হবে, আলোচনা হচ্ছিল। সিদ্ধান্ত হলো আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ সংশোধন করে এই বাহিনী গঠন করা হবে। ২০০৩ সালে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (সংশোধন) আইন, ২০০৩-এর মাধ্যমে এই এলিট ফোর্স র্যাব গঠন করা হলো। র্যাবের জনক বা প্রতিষ্ঠাতা লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৭ সালে সেই র্যাবের হাতেই গ্রেপ্তার হয়ে বিগত ১৬ বছর কারারুদ্ধ হয়ে আছেন।’
আপনার মতামত জানানঃ