বিঘার পর বিঘা জমি, নানা জায়গায় ফ্ল্যাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট, দেশে-বিদেশে সম্পদ কী নেই তাদের? এই যে শত শত দলিলে বা সরকারি নথিতে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের নামে তারা এসব সম্পদ গড়লেন রাষ্ট্রীয় কোন প্রতিষ্ঠান সেগুলো দেখলো না?
অথচ সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী, বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছর পর পর সম্পদের বিবরণ জমা দেয়ার কথা। আবার সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তাদের ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। আবার কোন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি করলে দুর্নীতি দমন কমিশনের সেগুলো দেখার কথা। কিন্তু এতোসব নিয়ম কানুন যেন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ!
ছাগল-কাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে পুঁজিবাজারেও তার বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। ২৫ জুন তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। প্রশ্ন হলো এতোদিন দুদক বা বিএফআইইউ কোথায় ছিলো?
অন্যদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী, সন্তান ও কয়েকজন স্বজনের নামে প্রায় ১১৪ একর বা ৩৪৫ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের নামে অন্তত ছয়টি কম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা পাওয়া গেছে। দুদকের আবেদনে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ১১৯টি দলিলে উল্লেখিত সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন। একই প্রশ্ন এখানেও। দুদক কোথায় ছিলো এতোদিন?
বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায়, রাজউক বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু করে সরকারের নানা দপ্তরে ছোট পদে চাকুরি করেন কিন্তু কোটি কোটি টাকার সম্পদ তাদের। তবে বেনজীর আহমেদ আর মতিউর রহমানের সম্পদ বিবরণী দেখে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মাত্রা নিয়ে ফের নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। কেন তারা এতোদিন চুপ ছিলেন? প্রশ্ন উঠেছে দুদকের ভূমিকা নিয়েও।
দুদক আইন-২০০৪ ও দুদক বিধিমালা-২০০৭ অনুসারে সরকারি চাকরিজীবীদের দায়িত্ব পালনের সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ বা উপঢৌকন গ্রহণ করছেন কী না, বেআইনিভাবে নিজ নামে কিংবা
বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন কী না সেগুলো দেখার কথা। কিন্তু দুদক বাংলাদেশের বড় কোন কর্মকর্তাকে এমন অপরাধে শাস্তি দিয়েছে এমন ঘটনা বিরল। আবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি অনুমতি ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেন দুদকে আইনে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সাবেক আইজিপি কিংবা মতিউর রহমানের সময় দুদক কোথায় ছিল তাহলে?
ঘটনা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, শুধু এই দুজন নয় সরকার বা ক্ষমতাশালীদের আশ্রয় প্রশয় ছিলো বা থাকে বলেই এমন দুর্নীতিবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সরকারের সুনজরে রয়েছেন এমন কারো বিরুদ্ধে দুদক কখনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস করে না। পুলিশ, প্রশাসনসহ বাকি সবারও তখন চোখ বন্ধ থাকে। যখনই সরকারের উচ্চপর্যায়ের সুনজর থেকে কেউ দূরে সরে যায় কিংবা ছাগলকাণ্ডের মতো বা অন্য কোনোভাবে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখনই দুদক কারও কারও বিরুদ্ধে তৎপর হয়। বাকি সময় তারা চুনোপুটি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ফলে দুর্নীতি বাড়তেই থাকে।
পুলিশ বা আমলাতন্ত্রের উপর সরকারের অতি নির্ভরশীলতা এবং এর ফলে উচ্চপদের কর্মকর্তাদের দুনীতি দেখেও দায়মুক্তি দুর্নীতির একটা বড় কারণ। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ কেন কী কারণে সরকারের কতোটা প্রভাবশালী ছিলেন সেটা অনেকেরই কম বেশি জানা। তবে সরাসরি পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মকর্তা না হয়ে সদ্য সাবেক এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান কতটা ক্ষমতাবান ছিলেন, তার বিবরণ পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের কথায়। তিনি কয়েকদিন আগে একটা বেসরকারি টেলিভিশন টকশোতে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই আমলেই অর্থমন্ত্রীদের বাসায় মতিউরের যাতায়াত ছিলো। মতিউরের বদলি ঠেকানোর জন্য একজন সাবেক সেনা প্রধানসহ কয়েকজন জেনারেল পর্যন্ত তদবির করেছিলেন।
বদিউর রহমান বলেন, এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়ে তিনি রুটিনমাফিক কর্মকর্তাদের বদলির সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় মতিউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে যুগ্ম কমিশনার। তাকে যেদিন রাজশাহীতে বদলির সিদ্ধান্ত হয়,সেদিনই বোর্ডের চারজন সদস্য দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘আপনি মতিউরকে বদলি করলেও রাখতে পারবেন না।’কিন্তু বদিউর রহমান তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। কিন্তু এরপর সামরিক ও বেসামরিক মহল থেকে তার জন্য তদবির আসতে থাকে। এমনকি তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমদ মতিউরের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন। জবাবে বদিউর রহমান বলেন, তাকে এনবিআরের চেয়ারম্যানের পদ থেকেই সরিয়েই সেটি সম্ভব। সত্যি সত্যি বদিউর রহমান বিদায়ের পর স্বপদে ফিরে আসেন মতিউর।
এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাহজনীতিবিদ কিংবা উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের এক ধরনের সখ্য থাকে। কখনো সেটা সম্পর্কের কখনো সেটা টাকার। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় প্রশয় ছাড়া বড় কর্মকর্তারা দুর্নীতি করতে পারবেন না। আবার বড় কর্মকর্তা বা ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় প্রশয় বা ছাড়া ছোট কর্মচারীরা দুর্নীতি করতে পারবেন না।
একটা ঘটনা মনে করাই। ২০১৮ সালের অক্টোব মাসে নগদ ৪৪ লাখ টাকা, আড়াই কোটি টাকার এফডিআর এবং এক কোটি ৩০ লাখ টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের তিনটি চেকসহ চট্টগ্রামের এক জেলারকে ভৈরব থেকে রেল পুলিশ আটক করে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চট্টগ্রাম কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসার অভিযোগ ছিলো। গ্রেপ্তারের পর ওই কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ডিআইজিসহ সব বড় কর্মকর্তাদের তিনি নিয়মিত ঘুসের টাকা পৌঁছে দিতেন।
বাংলাদেশের দুর্নীতির টাকা যেন এভাবেই যেন নানাজনের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। থানার ওসি থেকে শুরু করে সাবরেজিস্ট্রার বা সরকারের এমন অনেক দপ্তর আছে যেখানে বদলি বানিজ্য মানে কোটি কোটি টাকার কারবার। আবার হাসপাতালের কেনাকাটা থেকে শুরু করে জেলখানার মাদকব্যবসা নিয়ন্ত্রণের টাকার ভাগ নানা জায়গায় ভাগাভাগি হয়। ফলে দুষ্টচক্র আর ভাঙে না। বর দুর্নীতি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিকভাবেও দুর্নীতিবাজদের মেনে নেওয়ার প্রবনতা বাড়ছে। যে কোনভাবে টাকা আয় করতে পারলে, সম্পদ গড়তে পারলেই যেন এখন সব মর্যাদা।
রাজউক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের এমন অসংখ্য কর্মচারী রয়েছেন যাদের বেতন বিশ থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে অথচ রাজধানীতেই তাদের একাধিক ফ্ল্যাট, স্ত্রী সন্তান স্বজনের নামে বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। কিন্তু তাদের আয় নিয়ে সমাজ বা পরিবার এখন সেভাবে আর প্রশ্ন করে না। অথচ অংকটা খুব জটিল না।
আইজিপি, সচিব থেকে শুরু করে এই বাংলাদেশে একজন যতো বড় কর্মকর্তাই তিনি হন না কেন এই রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ পদে বেতন স্কেল ৭৮ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়াসহ সবমিলিয়ে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা তিনি পেতে পারেন। এই যুগে সব খরচ সামলে এই টাকা দিয়ে তিনি কীভাবে এতো সম্পদের মালিক হন, কী করে তাঁর এতো জমিজমা, ফ্ল্যাট, গাড়ি বাড়ি থাকে সেই প্রশ্ন তোলা উচিত কিন্তু তোলা হয় না। বরং টাকা আর সম্পদ থাকলে সামাজিকভাবে সব মেনে নেওয়ার যে মানসিকতা তার ফলে বিসিএস তথ্য ক্যাডারের চাকুরি ছেড়ে নন-ক্যাডার সাবরেজিস্ট্রার পদে যোগ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
আসলে দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, এটি সামাজিক মূল্যবোধকেও দুর্বল করে দেয়। দুই তিন দশক আগেও যে লোকটা দুর্নীতি করতো বা ঘুস খেতো তার দিকে সবাই বাঁকা চোখে তাকাতো। কিন্তু আজকাল যে কোন ভাবে টাকা আয় করলেই, গাড়ি বাড়ি সম্পদ থাকলেই দেখা যায় সমাজ তাকে তোয়াজ করছে। মসজিদ কমিটির সভাপতি থেকে শুরু করে নানান পথ পদবিতে তারা বসছে। বেশিরভাগ মানুষ তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে চায়। সমাজে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে কার চেয়ে বেশি আয় করবে কারণ সেটাকেই সাফল্যের মানদণ্ড ধরা হয়। কাজেই রাষ্ট্রকে যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে তেমনি সামাজিকভাবেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে হবে।
২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম। সেই স্বাধীনতার পর থেকে দুর্নীতি যে শুরু, স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, সব ছাড়িয়ে গত ১৫ বছরে হলমার্ক কেলেঙ্কারি-বেসিক ব্যাংকে লুটপাট, ব্যাংকিং খাতের ধ্বংস, স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, রূপপুরের বালিশকাণ্ড থেকে শুরু করে বিদেশে টাকা পাচার থেকে শুরু করে; দুর্নীতি যেন ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
বাংলাদেশে ঠিক কতো টাকার দুর্নীতি হয় বছরে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ঋণদাতা গোষ্ঠীর স্থানীয় পরামর্শক দলের (এলসিজি) সঙ্গে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় দুর্নীতির কারণে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ নষ্ট হয় বলে জানিয়েছিলেন ওই সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই পরিমাণের কথা বলেছিলেন তিনি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপনের সময়ও।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা তথ্যমতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বিচার-এসব সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থের দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো হবে। আর সরকারি বড় বড় কেনাকাটায় যোগসাজশের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ হবে জিডিপির ৩ শতাংশের মতো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দুর্নীতির আকার দাঁড়াবে জিডিপির ৫ শতাংশ।
দুর্নীতি কমবে এমন প্রত্যাশায় ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন শতভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছিল৷ ফলে বেতন ও অবসরভাতা মিলিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পেছনে বছরে সরকারের ব্যয় দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ৷ কিন্তু দুর্নীতি উল্টো বেড়েছে।
২০১৭ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের কাছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পাঠানো এক আধা সরকারি পত্রে বলা হয়েছিল, দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যোগ হতে পারছে না। এই হিসাব অবশ্য রক্ষণশীলভাবে করা। জিডিপির চলতি মূল্যকে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে বছরে অঙ্কটা দাঁড়াবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
চিঠি পাওয়ার পর দুর্নীতি রোধে তদারকব্যবস্থা জোরদার করতে দেশের সব সচিবের উদ্দেশে চিঠি পাঠিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তবে গত সাত বছরে দুনীতি তো কমেনি, উল্টো অরো বেড়েছে। সর্বগ্রাসী এই দুর্নীতির ফলে সাধারণ মানুষ কিন্তু নানাভাবে সংকটে পড়েন। এই যে খেতে গিয়ে ভবনে আগুন কিংবা বাস বা লঞ্চের যে কোন দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই। সন্তানের মৃত্যুর পর জানা যায় হাসপাতালের অনুমোদন নেই। এসবই দুর্নীতির ফলাফল। এগুলো দেখার জন্য রাজউক, বিআরটিএ, ওয়াসা, তিতাস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ কতো যে সরকারি সংস্থা আর মন্ত্রনালয় আছে! কিন্তু প্রত্যেকটা সরকারি সেবা সংস্থায় গড়ে উঠেছে দুর্নীতির পাহাড়। অধিকাংশ সময় অভিযোগ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত ২০ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছেন, দুর্নীতির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ আমলাদের থামাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি। সরকারি কর্মচারীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বার্ষিক হিসাব বাধ্যতামূলক করার কথাও বলেন তিনি।
এর আগে আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকরিজীবীরা। কানাডার টরন্টোয় বাড়ি করা বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে ওই অনুষ্ঠানে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর টাকা পাচারের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশরের ভূমিকায় (দুদক) অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাই কোর্ট বেঞ্চ দুদকের কৌঁসুলি মো. খুরশীদ আলম খানকে আদালতে বলেন, “বিদেশে এত লোক টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের একজনের নামও পাননি! উই ওয়ান্ট টু সি দুদক কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আপনারা অন্ততপক্ষে এটা দেখান যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। টাকা আসবে কি আসবে না, সেটা পরে দেখা যাবে।”
আফসোস কিছু হয়নি। বরং সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দুবাইতেও একদল বাংলাদেশি বিপুল সম্পদের মালিক। যুক্তরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর কোথায় তাদের সম্পদ নেই? বেগমপাড়ার কথা তো অজানা নয়। ছাগলকাণ্ডের মতিউর রহমানের পরিবারের সদস্যদের কানাডায় যে দামী গাড়ি চড়তে দেখা গেছে সাধারণ একজন সরকারি কর্মকর্তার সারাজীবনের আয় দিয়েও তো এমন গাড়ি কেনা অসম্ভব।
গত ২০ জুন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, দেশ থেকে বছরে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয় (৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার)। তার মতে টাকা পাচার থেকেই ডলার সংকটের শুরু। তাই জরুরি ভিত্তিতে এটি রোধ করার পদক্ষেপ দরকার।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি ও হুন্ডির মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট।
সরকারি বিধান অুনযায়ী, পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর নিজ সম্পদ বিবরণী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার কথা। তবে চাকরির সেই আচরণবিধি কর্মকর্তারা মানছেন না। আবার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থারও এই হিসেব নেওয়ার কোন তাগাদা নেই। উল্টো সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল অনুসারে ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না৷ ফলে দুর্নীতিবাজরা এক ধরনের দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
প্রশ্ন হলো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধের উপায় কী? প্রচলিত বিধানেই কিন্তু এটি সম্ভব। পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান পুরোপুরি মানতে হবে। প্রয়োজনে প্রতি বছর সম্পদের হিসেব নেওয়া যেতে পারে। চাকরিতে ঢোকার সময় নবীন কর্মকর্তারা শুরুতেই তাদের সম্পদের যে বিবরণী জমা দেন। এরপর প্রতি বছর বছর তদের সম্পদের হিসেব নিয়ে যাচাই বাছাই করলে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কেউ যদি সম্পদের ঘোষণা না দেন এবং পরে সম্পদ পাওয়া যায় সেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত। দুদককে এখানে সক্রিয় হতে হবে। মনে রাখতে হবে দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তারা সুরক্ষা পেয়ে গেলে বাকিরা মনে করবে দুর্নীতি করলে পার পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গত ২৫ জুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহিষ্ণুতা) নীতি ঘোষণা করেছে। তারপরও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং আরও নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে তাদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে?
চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর সরকারি কর্মচারীদের হলফনামা আকারে সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান করার দাবি জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা। একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতিতে না জড়ান, সে জন্য আইন আরও কঠোর করতে পরামর্শ দেন তিনি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আরেক সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী মোতাহার হোসেন অভিযোগ করেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা দেশে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। কিন্তু দোষ হয় রাজনীতিবিদদের।
সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ নিয়ে আবার ভাবার পরামর্শ দিয়ে হানিফ বলেন, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে তাঁদের গ্রেপ্তারে অনুমতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। এই আইন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করছে বলেও মনে করেন তিনি।
হানিফ বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রথমে ভোগের রাস্তা বন্ধ করতে হবে। গাড়ি ও স্বর্ণালংকারের দোকান থেকে তালিকা (যারা কিনেছেন) নিয়ে বৈধ আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হোক। একইভাবে জমি, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট রেজিস্ট্রেশন যারা করছেন, তাঁদের তালিকা নিয়ে আয়ের বৈধ উৎস জানার জন্য কৈফিয়ত চাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় সম্পদের হলফনামা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রতি পাঁচ বছর পর বা পদোন্নতির সময় আবার হলফনামা জমা দেওয়ার বিধান চালু করার পরামর্শ দেন তিনি।
সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আজকে আমরা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। আমি ১৯৮৫ সালে যখন উপজেলা চেয়ারম্যান হই, তখন হাতীবান্ধায় ১০টি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৮৭ সালে সার্ভে করে হিসাব করলাম ইউনিয়নগুলোর পাকা বাড়িগুলো কাদের। দেখলাম, ৯২ শতাংশ বাড়ি হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের।’ সরকারি দলের এই সদস্য বলেন, ‘এত বাড়ি, এত জমি, এত ঘরবাড়ি হলো, আমাদের এত ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা) কেউই টের পেল না। রক্ষক ভক্ষক হলে যা হয়, সেটাই হয়েছে। এদের হাতেই সবকিছু।’
কোন আমলা যদি এখন পাল্টা প্রশ্ন করেন আওয়ামী লীগের এই নেতাদের যে রাজনীতিবিদরা কেন দুর্নীতি বন্ধ করে না তার উত্তর কী হবে? আসলে একটা দেশে দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনীতিবিদ ও আমলাসহ সবাইকে জবাবদিহিতায় আনতে হবে। দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় প্রশয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে তেমনি সামাজিকভাবেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে হবে। কবিগুরু লিখেছিলেন, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে। কাজেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে যেমন সোচ্চার হতে হবে তেমনি সামাজিকভাবেও প্রশ্ন তুলতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ