“আমি ভীষণ চিন্তায় রয়েছি। এতটাই চিন্তায় রয়েছি যে আমার বাপ-দাদার ভিটে বিক্রি করে এখান থেকে চলে যেতে হচ্ছে। আমার ছোট ছোট সন্তান আছে। প্রতিবার আমাদের বাড়িকেই নিশানা বানানো হয়”, কথা বলতে বলতে অঝোরে কাঁদছিলেন বছর ৪৭-এর মুহাম্মদ রইস। ভারতের রাজস্থানে যোধপুরের বাসিন্দা তিনি।
মুহাম্মদ রইস বলে চলেন, “আমি শেষ হয়ে গিয়েছি। ডিসেম্বর মাসে আমার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা। একটু একটু করে সমস্ত জিনিস পত্র একত্র করছিলাম। সেই সব নিয়ে চলে গিয়েছে।”
যোধপুরের সুরসাগরে কয়েক দশকের পুরনো দোতলা বাড়ি রয়েছে মুহাম্মদ রইসের পরিবারের, যার নাম ‘শিফা বিল্ডিং’। ওই এলাকার ল্যান্ডমার্ক হিসাবে পরিচিত ‘শিফা বিল্ডিং’।
কিন্তু দিনকয়েক আগে একটা ঘটনাকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ার পর পাথর ছোঁড়া আর অগ্নিসংযোগের ফলে বাড়িটির বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
“ঘটনার পর থেকে আমরা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকছি। বাচ্চারা এখনও ছোট। আজকাল ভয় লাগে”, বলেছেন মুহাম্মদ রইস।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাজস্থানের যোধপুর জেলার সুরসাগর থানা এলাকায় একটা ঘটনাকে ঘিরে ঝামেলা সাম্প্রদায়িক বিবাদের রূপ নেয়। এতে হিন্দু ও মুসলিম. উভয় পক্ষের লোকজন আহত হয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে দুপক্ষেরই।
সেই ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর রোববার সুরসাগর থানায় বিক্ষোভ দেখান কয়েকজন মুসলিম নারী। এলাকায় এখনও উত্তেজনা রয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্কও রয়েছে।
গত ২১শে জুন সুরসাগর থানা এলাকায় একটা সামান্য বিবাদ হঠাৎই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার রূপ নেয় বলে অভিযোগ। পুলিশি হস্তক্ষেপে একবার বিবাদের নিষ্পত্তি হলেও পরে গভীর রাতে পাথর ছোঁড়া এবং অগ্নিসংযোগের কারণে বহু মানুষ আহত হয়েছে।
উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারও করা হয়েছে কয়েকজনকে।
সুরসাগরের ব্যবসায়ী মহল্লার বাসিন্দা আসিফ খান পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বিবিসির সঙ্গে ফোনে কথোপকথনের সময় তিনি বলেন, “প্রধান সড়কে একটা ঈদগাহ রয়েছে, যার গেট সরানোকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের কথা চলতে থাকে এবং ক্রমশ বিবাদ বাড়তে থাকে। তবে সন্ধ্যে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে এই বিষয়ে সবাই একটা সমঝোতায় পৌঁছায়।”
“কিন্তু সেই সমঝোতা হওয়ার পর লোকজন তাদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই দু’দিক থেকে পাথর ছোঁড়া শুরু হয়। এরপরই এই ঘটনা বড় আকার নেয়।”
যোধপুরের পুলিশ কমিশনার রাজেন্দ্র সিং এই ঘটনাকে ‘তাৎক্ষণিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে সুরসাগর থানার ইনচার্জ মঙ্গি লাল বিবিসিকে ফোনে বলেন, “সুরসাগর মেন রোডে অবস্থিত ঈদগাহের মূল ফটকের কাছে একটা গাছ আছে। তার কাছেই ভৈরবজির মন্দির। শুক্রবার ঈদগাহ থেকে সড়কের পূর্ব পাশে দুটো গেট তৈরি করা হয়। এরপর সেখানে লোকজন জড়ো হতে থাকে।”
“আমরা থানায় ডেকে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করাই, যেখানে স্থির হয়েছিল পূর্ব দিকের গেট খোলা হবে না এবং ভৈরব মন্দিরে নির্মাণ কাজ হবে না।”
“এই সমঝোতার পর দুই পক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয় যা পরে পাথর ছোঁড়াছুঁড়ির আকার নেয়। সেখান থেকেই বিবাদটা বড় হয়ে ওঠে।”
ওই এলাকায় অন্য একটি বিবাদের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দা হরি দেওরা বিবিসিকে বলেন, “বজরং দলের সঙ্গে যুক্ত এক অল্পবয়সী ছেলে এই এলাকায় তার মামার বাড়িতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় ছবি পোস্ট করেছিল ওই নাবালক।”
“এরপর কয়েকজন মুসলিম ছেলে ওকে বাধা দেয়। জানতে চায় ওই ছবি কেন আপলোড করেছে সে। ছেলেগুলো ওই নাবালককে মারধরও করে। পরে দু’পক্ষ থেকেই এফআইআর দায়ের করা হয়। এই বিবাদও কিন্তু সে সময় চলছিল।”
ব্যবসায়ী মহল্লার বাসিন্দা আসিফ খান বলেন, “সোমবার ঈদের দিন দু’জন নাবালকের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। বিষয়টা নিয়ে কয়েকদিন গোলমাল চলে।”
“তবে দুই পরিবারের মধ্যে ভাল সম্পর্ক রয়েছে। একে অন্যের বাড়িতে যাতায়াতও আছে। ঝামেলার পর বিষয়টা পুলিশের কাছে গেলে পারস্পরিক সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল।”
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদের পাশাপাশি দুই নাবালকের মধ্যে ওই ঝগড়াও ওই এলাকায় সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে তার একটা কারণ বলে অভিযোগ।
যোধপুর পশ্চিমের ডিসিপি রাজেশ যাদবকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য বলেন, “দুটো ছেলের মধ্যে ঝগড়াটা একটা ছোট ঘটনা ছিল।” “মূল ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার, তারপরই এই বিবাদের সূত্রপাত হয়।”
আপনার মতামত জানানঃ