এমন গা-ছমছমে অভিজ্ঞতা কি আপনার কখনও হয়েছে যে আপনি জানেন ঘরে আপনি একা- কিন্তু মনে হচ্ছে ঘরে আর কেউ রয়েছে?
অনেক সময় এমন অভিজ্ঞতা আমরা স্বীকার করতে চাই না। ভাবি মনের ভুল! আবার এধরনের অশরীরী উপস্থিতি অনেক সময় অনেকের জন্য এমন বিশাল একটা অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে যে তারা ভাবে এটা কিছুতেই মনের ভুল হতে পারে না – এটা বাস্তব! বিজ্ঞান বলছে এটা দু’য়ের মাঝামাঝি একটা কিছু। কিন্তু কী সেটা?
এই অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা দিয়ে বিশ্লেষণ না করা গেলে মানুষ এ ধরনের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। এখন গবেষণায় জানা গেছে এ ধরনের অশরীরী উপস্থিতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বেন অল্ডারসন-ডে।
বিষয়টি নিয়ে অন্যতম সবচেয়ে বড় একটি গবেষণা চালানো হয় সেই ১৮৯৪ সালে। সোসাইটি ফর সাইকিকাল রির্সাচ (এসপিআর) “সেন্সাস অফ হ্যালুসিনেশন্স” অর্থাৎ অলীক কিছু দেখা বা শোনার বিষয়ে তাদের এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে, যে জরিপ চালানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ১৭ হাজারের বেশি মানুষের ওপর।
কোন অশরীরী বা অলৌকিক কিছু এসে আগাম নোটিশ দিয়ে যাচ্ছে যে, একটা মৃত্যু ঘটতে চলেছে, আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব এমন অভিজ্ঞতা কত মানুষের জীবনে ঘটেছে তা জানাই ছিল এই জরিপের মূল লক্ষ্য।
ওই গবেষণা জরিপের ফলাফলে দেখা যায় অনেকে এধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, এবং সংখ্যাটা উড়িয়ে দেবার মত নয়। (জরিপে প্রতি ৪৩ জনের মধ্যে একজন এমন অভিজ্ঞতার কথা বলেন)
এই সংস্থা থেকে এর আগে, ১৮৮৬ সালে, ভূত দেখার ওপর আরেকটি প্রকাশনা বের হয়, যেখানে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন এবং কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসনেরও উল্লেখ ছিল।
সেখানে ৭০১টি বিচিত্র ঘটনার কথা বলা হয়, যার মধ্যে ছিল টেলিপ্যাথি বা কোন ইন্দ্রিয় ব্যবহার না করে আরেকজনের মন পড়তে পারা, প্রিমোনিশন বা কিছু ঘটতে চলেছে আগে থেকেই তা জানা এবং এরকম আরও নানা ধরনের আপাত অবাস্তব বা অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বিবরণ।
যেমন, সেখানে ছিল ইংল্যান্ডের প্লিমাথ এলাকার ড্যাভেনপোর্ট শহরের একজন ধর্মযাজক পিএইচ নিউনহামের নিউজিল্যান্ড সফরে যাবার এক কাহিনি। যাত্রার আগের রাতে কোন এক অশরীরী তাকে বলেছিল পরদিন ভোরে ওই জাহাজে রওয়ানা না হতে।
পরে তিনি জানতে পারেন ওই জাহাজ ডুবে সব যাত্রী প্রাণে মারা যায়। সেসময় এসপিআর প্রকাশিত প্রবন্ধটি সমালোচিত হয় এমন সব উদ্ভট, ভুতুড়ে আর অবৈজ্ঞানিক কাহিনিকে গুরুত্ব দেবার জন্য।
এসপিআর পরে ১৮৯৪ সালে যে জরিপটি চালায় তা নিয়ে যদিও সেভাবে সমালোচনা বা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু অনেকে একথা বলতে ছাড়েনি যে জরিপে তারাই শুধু উত্তর দিয়েছে যারা মনে করে তাদের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেকে বলেছিল ‘কার মাথা খারাপ হয়েছে যে এমন জরিপে সাড়া দেবে!’
কিন্তু এখনও বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘরে ঘরে এধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায়। ফলে আধুনিক বিজ্ঞান এখন বিষয়টা বুঝতে চেয়েছে এবং তার ব্যাখ্যা দিয়েছে।
যা সুখস্বপ্ন নয়
গবেষণা সংস্থা এসপিআর যেসব ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেছিল তার বেশিরভাগই ছিল মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায় ‘হিপনোগগিয়া’। এটি হল পুরো ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মানসিক মুহূর্ত- অর্থাৎ জেগে থাকা আর ঘুম আসার মাঝের সময়কার অলীক বা অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার অনুভূতি।
উনবিংশ শতাব্দীর বেশ কিছু ধর্মীয় অভিজ্ঞতার কথা নথিবদ্ধ আছে যেগুলোর ভিত্তি মনে করা হয় হিপনোগগিয়া অবস্থায় দেখা স্বপ্নের অনুভূতি।
তবে অশরীরী কিছুর উপস্থিতির সঙ্গে জোরালো যোগাযোগ রয়েছে ‘স্লিপ প্যারালিসিস-এর, যে অভিজ্ঞতা, মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, প্রায় ৭% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জীবদ্দশায় অন্তত একবার ঘটে।
স্লিপ প্যারালিসিস হল ঘুমের সময়কার এমন একটা অবস্থা যখন আমাদের মাংসপেশিগুলোর নড়াচড়া থেমে যায়, সেগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক থাকে সজাগ আর সক্রিয়। এটা এমন একটা অবস্থা যখন আপনি আসলে জেগে আছেন, কিন্তু নড়তে পারছেন না, কথা বলতে বা চোখ খুলতে পারছেন না।
বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন যাদের স্লিপ প্যারালিসিস হয়, তাদের মধ্যে ৫০% বলেন তাদের মনে হয় ঘরে কেউ আছে।
ভিক্টোরিয় যুগের যেসব অভিজ্ঞতার ঘটনা এসপিআর নথিবদ্ধ করেছিল সেগুলোর বেশিরভাগই ভয়ঙ্কর বা ক্ষতিকর ছিল না। বেশিরভাগই ছিল ভাল লাগার অভিজ্ঞতা। কিন্তু বর্তমানে স্লিপ প্যারালিসিসের যেসব অনুভূতির কথা শোনা গেছে সেগুলো ভয়ঙ্কর বা নৃশংস কিছু দেখার অভিজ্ঞতা।
রাতে অশরীরী কিছুর উপস্থিতি নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে নানা বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন আমরা বলি ঘুমের মধ্যে ভূতে পাওয়া বা জিনে ধরা। পর্তুগালে বিশ্বাস আছে “হাতে ফুটো কোন অপদেবতা” স্বপ্নের মধ্যে বুকে চেপে বসে, পশ্চিম আফ্রিকার ইউরোবারা এই প্রক্রিয়াকে বলে ওগান অরু যা ঘুমের মধ্যে কোন ভূতের উপদ্রব। নাইজিরিয়ানদের বিশ্বাস ঘুমের মধ্যে অপঘাতে মৃত কেউ মানুষের শরীরে ভর করলে এমন অবস্থা হয়।
কিন্তু ঘুমের মধ্যে পেশি অচল হয়ে গেলে কারোর উপস্থিতি কেন মানুষ অনুভব করে? কোন কোন গবেষক বলছেন এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে মানুষ যখন জেগে ওঠার চেষ্টা করে তখন মনের মধ্যে তারা বিশেষ একটা কিছুকে অবলম্বন করতে চায়। তাই তারা কিছু একটা দেখে বা শোনে। স্লিপ প্যারালিসিস অনেকের জন্য বেশ ভয়ের একটা অভিজ্ঞতা।
ঘুম বিষয়ে গবেষক জে অ্যালেন চেইনি এবং টড জিরার্ড ২০০৭ সালে যুক্তি দেন যে ঘুমের মধ্যেকার প্যারালাইজড বা পেশির জড় অবস্থা থেকে যখন আমরা জাগি তখন আমরা একটা ভয়ের অবস্থায় থাকি- আমাদের মন বলে কিছু একটা খারাপ ঘটবে। মনের ভেতরে একটা শূন্য অবস্থা তৈরি হয়।
এ অবস্থায় সেই শূন্য জায়গাতে একটা ছবি বা পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ মস্তিষ্কে গড়ে ওঠে। আরেকটা ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে এধরনের অশরীরী কিছুর অস্তিত্ব বা এধরনের অনুভূতি শুধু যে হিপনোগগিয়া অবস্থায় এবং ঘুমের মধ্যকার প্যারালিসিসের সময় হচ্ছে তাই নয়, এমনটাও দেখা গেছে যে পার্কিনসন এবং সাইকোসিস রোগে, মুত্যুর মুখোমুখি পড়ার সময় এবং প্রিয়জনের মৃত্যুর পর মানুষের এমন অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হয়েছে।
স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় ব্রেনকে উদ্দীপ্ত করার পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে শরীরকে নির্দেশ দিলে মন এরকম অশরীরী কিছুর উপস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
যেমন, ২০০৬ সালে নিউরোলজিস্ট শাহার আর্জি এবং তার সহকর্মীরা এক পরীক্ষায় এক নারীর মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশে বৈদ্যুতিক কারেন্ট পাঠিয়ে তার সামনে একটি “ছায়া মূর্তি” সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
নারীটির শরীর যে অবস্থানে রয়েছে তার প্রতিবিম্ব হিসাবে আসে ওই ছায়ামূর্তি। ওই পরীক্ষায় দেখা যায় মস্তিষ্কের বিশেষ ওই অংশটি উদ্দীপিত হলে তা অনুভূতি ও শারীরিক অবয়ব তৈরি করতে পারে।
মস্তিষ্কের বিশেষ অংশ উজ্জীবিত করে অবয়ব সৃষ্টি সম্ভব করেছেন বিজ্ঞানীরা
২০১৪ সালে পরপর চালানো কয়েকটি পরীক্ষায় আরও দেখা যায় যে, মানুষ তার ইন্দ্রিয় দিয়ে যা দেখার প্রত্যাশা করছে তা এমনকি সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও বদলে দেয়া সম্ভব।
যেমন গবেষকরা রোবট ব্যবহার করে তার চলাফেরার সাথে মানুষের চলাফেরায় সামঞ্জস্য তৈরি করে দেখেছেন, মানুষ যখন ওই রোবটের গতিবিধির সাথে একাত্ম হয়ে যায়, তখন হঠাৎ করে রোবটের চলাফেরায় সামান্য হেরফের ঘটালে মানুষ মনে করে রোবটটা তো ছিল। অর্থাৎ রোবট না থাকলেও মানুষ ধরে নেয় রোবট আছে- যেটা হ্যালুসিনেশন- মানসিক বিভ্রম।
এই গবেষকরা অশরীরী কিছুর দেখার প্রক্রিয়ার পেছনে এটাকেই যুক্তি হিসাবে তুলে ধরছেন। অর্থাৎ স্লিপ প্যারালিসিসের সময় আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কের কাজ যেহেতু বিঘ্নিত হয় তার ফলে তৈরি হয় একটা হ্যালুসিনেশন আর সেটাই আমাদের চারপাশে – বিশেষ করে আমাদের পেছনে অশরীরী ছায়ার মত কিছুর উপস্থিতি তৈরি করে।
আমরা ভাবি ঘরে আর কেউ। কিন্তু ওই ‘আর কেউ’ আসলে আমরাই- আমাদের মনের ফসল।
মনস্তত্ত্ববিদ ড. বেন অল্ডারসন-ডে তার এই গবেষণা নিবন্ধে বলেছেন ২০২২ সালে তার নিজস্ব গবেষণায় অশরীরীর উপস্থিতি নিয়ে তিনি রোগীদের দেয়া বিবরণ, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার বিবরণ এবং খেলাধুলার জগতেও এধরনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলনা করে দেখেন। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই হ্যালুসিনেশন বা কিছু দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি দেখেন সবগুলো ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতার বেশ কিছু মিল রয়েছে। যেমন, সব ক্ষেত্রেই যাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা কারোর উপস্থিতি অনুভব করেছেন তাদের একেবারে পেছনে।
তিনটি গোষ্ঠির মানুষই এই ‘দেখা’কে ঘুমের সাথে সম্পর্কিত বলে বর্ণনা করেছেন। তারা আরও বলেছেন মানসিক আবেগের মুহূর্তে এই ‘দেখা’র ঘটনা ঘটেছে- যেমন দুঃখের মুহূর্তে বা প্রিয়জনের মৃত্যুর সময়।
যদিও অশরীরীর উপস্থিতি মানুষ অনুভব করে এসেছে আজ বহু শতাব্দী ধরে, কিন্তু এনিয়ে যথাযথ বৈজ্ঞানিক গবেষণা সবে শুরু হয়েছে।
আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়ত আমাদের সাধারণ কোন একটা ব্যাখ্যা দেবে অথবা কেন কেউ কেউ ঘরের মধ্যে অশরীরী কারোর উপস্থিতি টের পান সে বিষয়ে আসবে নতুন নতুন একাধিক তত্ত্ব।
আপাতত বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে নিশ্চিত যে মানুষ ভূত দেখার যেসব কাহিনি বলে, তারা মৃত মানুষের অশরীরী প্রেতাত্মা নয়, তারা জিন-ভূত নয়। তারা মানুষের মস্তিষ্কের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অবচেতন থেকে উঠে আসা কিছু ছবি।
দ্য কনভারসেশন নামে এক গবেষণা ওয়েবসাইটে ড. বেন অল্ডারসন-ডে-র গবেষণা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এই রিপোর্ট।
আপনার মতামত জানানঃ