ব্যাংকের ওপর চাপ কমাতে বন্ড মার্কেট থেকে সরকারের ঋণের জোগান বাড়ানোর পদক্ষেপটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইনি জটিলতায় বন্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়েনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া বন্ডে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার মতো সরকারি-বেসরকারি খাতে গড়ে উঠেনি বড় ধরনের কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান। ফলে বন্ড বাজার দুর্বলই রয়ে গেছে। এ খাত থেকে সরকার বড় অঙ্কের ঋণের জোগান পাচ্ছে না।
যেসব বিল-বন্ড বিক্রি হচ্ছে, এর সিংহভাগই কিনছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ঋণের বড় অংশেরই জোগান আসছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। এতে ব্যাংকের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে। সরকারকে বড় অঙ্কের ঋণের জোগান দিতে গিয়ে বেসরকারি খাতে চাহিদামতো ঋণের জোগান দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। একই সঙ্গে ব্যাংক ভুগছে তারল্য সংকটে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সরকার চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, বাকি ২৩ হাজার কোটি টাকা নন-ব্যাংক খাত থেকে নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে নেবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আইএমএফ-এর চাপে এ খাতে ঋণ গ্রহণ কমাতে হয়েছে। ফলে জুলাই-ডিসেম্বরে এ খাত থেকে কোনো নতুন ঋণ নেয়নি। বরং আগের ঋণ বাবদ পরিশোধ করেছে ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। মোট ঋণের ৮৫ শতাংশই নেবে ব্যাংক খাত থেকে। বাকি ১৫ শতাংশ নেবে নন-ব্যাংক খাত থেকে। যদিও চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ৩ হাজার কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোয় আমানত কমায় এবং ঋণপ্রবাহ বাড়ায় তারল্য সংকট ছিল প্রকট। ফলে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ কমিয়ে টাকা ছাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণে ৯৭ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি চলে যায়। এতে সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। অর্থনীতিবিদ ও আইএমএফ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করতে বলে। চাপে সরকার চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। বরং আগের ঋণ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সরকারের ঋণের জোগান কমার কারণে উন্নয়ন খাতে অর্থের জোগান কমেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ ও ব্যাংকগুলোয় তারল্যের প্রবাহ ঠিক রাখতে ঋণ নেওয়া কমানোর ফলে সরকার এখন ঋণ সংকটে পড়েছে। চড়া সুদ ও নানা শর্তের কারণে বিদেশি ঋণও আসছে কম। ফলে ঋণের অভাবে সরকারকে ব্যয় সংকোচননীতিতে চলতে হচ্ছে।
এদিকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক দীর্ঘদিন সরকারকে বলে আসছে ব্যাংক ঋণ নেওয়া কমিয়ে বন্ড ছেড়ে ঋণ নিতে। এজন্য বন্ড বাজার উন্নয়নে সরকার ২০২৩ সাল থেকে কাজ করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রাইমারি মার্কেটের মতো সেকেন্ডারি মার্কেটও দুর্বল রয়ে গেছে। সরকার যেসব বন্ড বা বিল ছাড়ছে, সেগুলোর প্রধান ক্রেতাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তারা ছাড়া অন্য কোনো বড় প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে ওঠেনি বন্ড কিনে সরকারকে ঋণের জোগান দিতে। বেসরকারি খাতে তো নয়ই। এ অবস্থায় সরকারের ঋণের একমাত্র ভরসা ব্যাংকব্যবস্থা, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক। কিন্তু এ দুই খাত থেকেই এখন ঋণ নিলে অর্থনীতিতে সমস্যা আরও বড় করে তুলছে। এতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১১ ধরনের ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে সরকারের ঋণ নেওয়ার। এছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও সরকার সীমিত কিছু ঋণ দিতে পারে। ট্রেজারি বন্ড রয়েছে ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি। ট্রেজারি বিল রয়েছে ৩ মাস, ৬ মাস ও এক বছর মেয়াদি। ইসলামি বন্ড রয়েছে দুটি। এছাড়া শরিয়া ভিত্তিতে পরিচালিত বন্ড রয়েছে সুকক। এর বাইরে অন্য কোনো বন্ড বা বিল নেই। কিন্তু এশিয়ার অন্য দেশগুলোয় ট্রেজারি নোট, ট্রেজারি কুপন, জিরো কুপন, বিভিন্ন ধরনের সরকারি বন্ড রয়েছে। এগুলোয় আকর্ষণীয় মুনাফা দেওয়া হয়। যে কেউ এগুলোয় বিনিয়োগ করতে পারে। এসব বন্ডে বিনিয়োগ করতে বেসরকারি খাতে অসংখ্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এসব কিছুই নেই।
বেসরকারি খাতও ঋণের বড় অংশই নিচ্ছে ব্যাংক থেকে। ঋণের জন্য তারা বন্ড বা ডিভেঞ্চারে (ঋণপত্র) যাচ্ছে খুবই কম। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের চাপও পড়ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু এর সঙ্গে তালমিলিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এগোতে পারছে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী অর্থনীতিতে ঋণের জোগান আসছে না। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে ২০০৭ সালে প্রথম বন্ড ইস্যু করা হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত চারটি প্রতিষ্ঠান মোট ৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছে, যা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ। এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক মুদারাবা পারপিচুয়াল বন্ড ২০০৭ সালে ইস্যু করা হয় ৩০০ কোটি টাকার, এসিআই ২০ শতাংশ রূপান্তরযোগ্য জিরো কুপন বন্ড ২০১০ সালে ইস্যু করা হয় ১০৭ কোটি টাকার। ব্র্যাক ব্যাংক বন্ড ৩০০ কোটি টাকার ইস্যু করা হয় ২০১১ সালে। সবচেয়ে বড় অঙ্কের ৩ হাজার কোটি টাকার গ্রিন বন্ড ইস্যু করে বেক্সিমকো গ্রুপ। গ্রিন সুকক নামের এ বন্ড ২০২১ সালে ইস্যু করা হয়। ৮টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৪৩ কোটি টাকার ঋণপত্র করেছে, যা মোট বেসরকারি ঋণের দশমিক ১ শতাংশেরও কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে জিডিপির মাত্র ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠান বন্ড ছেড়ে নিয়েছে মাত্র দশমিক ১৯ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়া সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে মোট জিডিপির ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড ছেড়ে নিয়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। ভিয়েতনামে সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। ফিলিপাইনে সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে ৪১ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে ৩৭ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
মালয়েশিয়ার সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে জিডিপির ৭২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৫৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। থাইল্যান্ডে সরকারি বন্ডে নিয়েছে জিডিপির ৫১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ২৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঋণ। চীন সরকারি বন্ডের মাধ্যমে নিয়েছে ৭১ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ নিয়েছে ৬০ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৮৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, অন্যান্য দেশের তুলনায় বন্ড ছেড়ে সরকার ঋণ নিয়েছে খুবই সামান্য। বেসরকারি খাতের বন্ডের বাজার প্রায় অস্তিত্বহীন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বাজারে বন্ডের বহুমুখী উপকরণ আসেনি। এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়েছে। ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদ দেওয়া হচ্ছে এগুলোয়। কিন্তু এরপরও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই। এক্ষেত্রে বড় কারণ বন্ডে বিনিয়োগ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। এ বিষয়ে কোনো প্রচারনাও নেই। শেয়ারবাজারের সেকেন্ডারি মার্কেটে কিছু বন্ড ও বিল লেনদেনের জন্য তালিকাভুক্ত হলেও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ না থাকায় লেনদেন হচ্ছে না।
ট্রেজারি বিল বন্ড ও জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে ঋণের স্থিতি ছিল ৪০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। সাত বছরে তা বেড়েছে ৪২ শতাংশ। এর সিংহভাগই বেড়েছে ব্যাংক খাত থেকে। ফলে ব্যাংক খাতেই চাপ বেশি বাড়ছে।
আপনার মতামত জানানঃ