ভারতে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পুলিশি হেফাজতে, হাসপাতালে বা রিমান্ড হোমে থাকাকালীন অন্তত ২৭৫ জন নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে বলে সরকারি পরিসংখ্যানেই জানানো হয়েছে। সম্প্রতি ‘কাস্টডিয়াল রেপ’ বা হেফাজতে থাকাকালীন (ওই ছয় বছরে নথিভুক্ত হওয়া) ধর্ষণের ঘটনার এই তথ্য প্রকাশ করেছে ভারতের ন্যাানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হেফাজতে থাকাকালীন সব চেয়ে বেশি ধর্ষণের অভিযোগ ভারতের যে রাজ্য থেকে মিলেছে সেটি হল উত্তরপ্রদেশ, আর তার পরেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশ।
উল্লিখিত ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পুলিশি হেফাজতে, জেলে, হাসপাতালে, রিমান্ড হোম-সহ ‘হেফাজতে থাকাকালীন’ মোট ৯২টি ধর্ষণের মামলা রুজু করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে এবং ৪৩টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে মধ্যপ্রদেশে।
এই পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আসার পরই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইনজীবী, মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য এবং সমাজকর্মীরা।
প্রবীণ সমাজকর্মী শবনম হাশমি বলেছেন, “নারীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। নারীদের দাবিয়ে রাখতে ধর্ষণকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়, সেটা হেফাজতে থাকাকালীন হোক বা বাইরে।”
“তবে শুধু ধর্ষণ নয়, যারা অভিযুক্ত তাদের আড়াল করার যে ঘটনা আমরা একের পর এক দেখে আসছি তাও কিন্তু বাড়ছে”, জানান তিনি।
সম্প্রতি ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ‘কাস্টডিয়াল রেপ’ বা পুলিশি হেফাজত, হাসপাতাল, সেফ হোমের মতো স্থানে নারীদের ধর্ষণের ঘটনার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ৩৭৬ (২) ধারা অনুযায়ী ওই ধর্ষণের অভিযোগগুলি দায়ের করা হয়েছিল।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ (২) ধারা তখনই লাগু করা হয় যদি ধর্ষণে অভিযুক্তরা পুলিশ কর্মী, জেলের কর্মী, সেনা কর্মকর্তা, হাসপাতালের কর্মী, হোমের আধিকারিক বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ হন।
হেফাজতে থাকা নারীদের সুরক্ষার দায়িত্ব ওই সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথা কর্মীদেরই। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য বলছে হেফাজতে থাকাকালীন ২০২২ সালে ২৪টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
২০২১ সালে ২৬টি, ২০২০ সালে ২৯টি, ২০১৯ সালে ৪৭টি, ২০১৮ সালে ৬০টি এবং ২০১৭ সালে ৮৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্যের নিরিখে ‘হেফাজতে’ থাকা অবস্থায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ২০১৭ এর তুলনায় কমলেও ‘হেফাজতে’ থাকা অবস্থায় ‘নিরাপত্তা’ যে প্রশ্নের মুখে সে বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টরা। প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশ দু’টি রাজ্যই বিজেপি শাসিত।
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গুজরাট দাঙ্গার সময় বিলকিস বানোর গণধর্ষণ এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের জেলে ফেরত যাওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, তার উল্লেখ করেছেন সমাজকর্মী শবনম হাশমি।
তিনি বলেন, “ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনার পর অভিযুক্তদের বিচার হল, সাজা হল সেটা এক, আর সরকার তাকে আড়াল করছে, বাঁচানোর চেষ্টা করছে সেটা আরেক। একই ঘটনা আমরা দেখেছি হাথরাসের ক্ষেত্রে এবং বিলকিস বানোর মামলাতেও।”
“অভিযুক্তদের শুধুমাত্র সাজাই মকুব করে দেওয়া হয়নি তাদের সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র যদি অভিযুক্তদের সঙ্গে হাত মেলায় তাহলে তারা (অভিযুক্ত) আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এটা পুরো ভারতের চিত্র।””
“উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশেও একই ছবি ফুটে উঠেছে। দুই রাজ্যেই একই সরকার ক্ষমতায়।তাই এই পরিসংখ্যান খুবই পীড়াদায়ক কিন্তু এসব আমাকে আর অবাক করে না”, বলছিলেন শবনম হাশমি।
হাসপাতাল বা রিমান্ড হোমের মতো স্থানেও একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ওই পরিসংখ্যানে রয়েছে। সে বিষয়ে তিনি বলেন, “আসলে নারীকে একটা নির্দিষ্ট ভাবেই দেখা হয়, সেটা যেখানেই হোক। এবং নারীদের অবস্থান সমাজে উত্তরোত্তর নীচে নামছে। সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন ছাড়া তাদের আর কিছুই ভাবা হয় না। সম্মানের সঙ্গে তাদের প্রতি আচরণ করা হয় না। লিঙ্গ সমতাও নেই।”
তার মতে নারী নির্যাতনের ঘটনা যে আগে ঘটত না তেমনটা নয়, তবে রাষ্ট্র তাকে এখন ‘প্রশ্রয়’ দিচ্ছে সেটা সচরাচর দেখা যেত না।
“বছর দশেক আগে যে এমনটা ঘটত না তা নয়। তবে, রাষ্ট্র তাকে প্রশয় দিচ্ছে সেটা এভাবে প্রকাশ্যে দেখা যেত না। ঘটনার নৃশংসতা এবং সংখ্যা বেড়েছে সেটা নিঃসন্দেহে ঠিক।”
“আরও দুঃখের বিষয় হল এই জাতীয় অপরাধ যে কোনও জায়গায় দেখা যাচ্ছে ইদানীং, তা সে হাসপাতালে হোক, পুলিশ বা জেল হেফাজত হোক বা রাস্তাঘাটে। তার কারণ রাষ্ট্র এতে মদত দিচ্ছে,” বলছেন মানবাধিকার কর্মী শবনম হাশমি।
আপনার মতামত জানানঃ