বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক মন্দা এবং ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হারকে সহনীয় রাখা, খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর জন্য মুদ্রানীতিতে নেওয়া পদক্ষেপগুলোতে সফলতা অর্জন করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্জিত হয়নি ডলারের প্রবাহ, সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা। বলতে গেলে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্র্যন্ত সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা কোনো খাতেই অর্জিত হয়নি।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের মার্চে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে টানা লকডাউনের দিনে দেশে ও বিদেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। ক্রমেই তা প্রকট আকার ধারণ করে। এই মন্দা থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের আগেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এতে বৈশ্বিকভাবে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে থাকে।
এদিকে ২০২১ সালের আগস্টের পর থেকে দেশে ডলারের প্রবাহ কমে রিজার্ভ কমতে থাকে। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক মন্দা আরও বড় আকার ধারণ করলে দেশের একদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমতে থাকে, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। এতে রিজার্ভ আরও কমতে থাকে।
ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ সাশ্রয় করতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে থাকে। একই সঙ্গে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে ২০২২ সালের জুলাই থেকে। এতে দেশে আমদানি কমে যায়।
ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা এলসি খুলতে পারছেন না। যা এখনো বিদ্যমান। মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে যায় লাগামহীনভাবে। এসব কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের লক্ষ্যগুলো অর্জন হচ্ছে না। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদল, কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা, কঠোর তদারকির অভাবকেও দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শুরুতেই সংকট স্বীকার করে নিলে সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি করা যায়। কিন্তু সমস্যা স্বীকার না করলে তো তার সমাধানের পথও হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন স্বীকার করেনি। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।
ফলে কোনো খাতেই তা অর্জিত হয়নি। এখন সমস্যাগুলো স্বীকার করেছে। প্রতিকার করতে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। কিন্তু কতটুকু শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটি এখনো দেখার বিষয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্র্যন্ত সময়ে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ওই সময়ে অর্জিত হয়েছে ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ার কারণে টাকার প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এ কারণেও টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। এ ছাড়া বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ও মানুষের আয় কমায় ভোক্তার হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না। ফলে তারা সঞ্চয় করার প্রবণতা কমিয়ে দিয়েছেন। এতে টাকার প্রবাহ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না।
চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্র্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে বেড়েছে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ। এ খাতেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে বহু দূরে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিনিয়োগ না করায় বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমেছে।
তারল্য সংকট ও ব্যয় সংকোচননীতির কারণে সরকারও খরচ কমিয়েছে। ফলে সরকারও ঋণ কম নিয়েছে। এর সঙ্গে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির প্রভাব তো রয়েছেই। ফলে সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও যায়নি। সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
কিন্তু ডিসেম্বর পর্র্যন্ত সরকারের ঋণ বাড়েনি। উল্টো আগের চেয়ে কমেছে ৯ দশমিক ২১ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দার কারণে রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে।
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানি আয়ে। একই কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রবাহ। ফলে ডলারের প্রবাহ বাড়েনি। ডলারের প্রবাহ কমার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু কমেছে সাড়ে ১২ শতাংশ। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম কমেছে। কিছু বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়েছে, একই সঙ্গে রোজা উপলক্ষ্যে ঋণ করে পণ্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে ঋণের প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ায় এ খাতে কমার হার কমেছে। পরে বৈদেশিক ঋণ শোধের সময় রিজার্ভে আবার চাপ বাড়বে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বেড়েই চলেছে। রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। বড় অঙ্কের ঋণ পেলে রিজার্ভ সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও তা পরে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে গ্রস রিজার্ভ কমে এখন ২ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মানও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ডলার সংকটের কারণে এর দাম বেড়েই চলছে। বাজার পরিস্থিতি ও নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যকার ব্যবধানে এতটাই ফারাক দেখা দিয়েছে যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন নির্ধারিত দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের নির্ধারিত দর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৬ টাকা দরে।
এদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত অর্থবছরে টাকার জোগান বাড়ানো, ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছিল। এখন কিছুটা কমে ৯ শতাংশে নেমেছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এখনো সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। আগে তা সাড়ে ১২ শতাংশ পর্র্যন্ত উঠেছিল। এখন মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ভিত্তি উচ্চ পর্যায়েই রয়ে গেছে। ফলে ভোক্তাদের বাড়তি দামেই তা কিনতে হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ