প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে নির্মাণ করা এই বিস্ময়কর স্থাপনার কাঠামো এবং নির্মাণশৈলীর রহস্য নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনও এলিয়েন স্থাপনাগুলো বানিয়েছিল কিংবা শস্য সংরক্ষণের জন্য ফারাওরা এগুলো তৈরি করেছিল, এমন নানা ধারণা প্রচলিত আছে পিরামিডকে ঘিরে।
আসলেই কেন তৈরি করা হয়েছিল পিরামিড- তা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা। আর তাতে সাহায্য করেছে সাহারার শুষ্ক জলবায়ুতে সুরক্ষিত প্রাচীনকালের মিশরীয়দের লেখা, নির্মাণের মতো নানা প্রমাণ।
পিরামিড নির্মাণের আগে মিশরীয়দের কবর দেয়ার পদ্ধতি ভিন্ন ছিল। তখন সমাধি দেয়া হতো চারকোনা ছোট আকৃতির ঘরে, যার নাম ছিল ‘মাস্তাবা’। জাদুঘর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের ওয়েবসাইটে প্রাচীন মিশর নিয়ে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এর উল্লেখ রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব ২৭৮০ অব্দের দিকে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া আকৃতির পিরামিড নির্মাণের জন্য একটির ওপর আরেকটি– এভাবে ছয়টি ধাপে প্রথম পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছিল।
জোসের নামের একজন ফারাওয়ের জন্য নির্মাণ করা এই পিরামিডের কোনাগুলো মসৃণ না হলেও এটাকেই প্রথম সত্যিকারের পিরামিড হিসেবে ধরা হয়।
প্রচলিত আছে, এই সমাধির নকশাকারের নাম ছিল ইমহোতেপ। তাকেই পিরামিডের প্রথম নকশাকার হিসেবে ধরা হয়। প্রথম পিরামিড নির্মাণের পর পরবর্তী ফারাওরা আরও ভালো এবং বড় আকারের পিরামিড নির্মাণ শুরু করেন।
‘পিরামিড কারা বানিয়েছিল’ এই প্রশ্নের দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত উত্তর ছিল ‘দাস’। ধারণা করা হতো বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষদের ধরে এনে ‘নির্দয়’ ফারাওরা দাস বানিয়ে তাদের দিয়ে পিরামিড নির্মাণ করাতো।
আর এই ধারণার শুরু জুডিও-খ্রিস্টান ধারণা থেকে। পরে এটি জনপ্রিয়তা পায় সিসিল বি. ডি মিলের ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’র মতো হলিউড সিনেমার হাত ধরে। কিন্তু পিরামিডের দেয়ালে আঁকা ছবিগুলো থেকে ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে।
এ নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাধীনভাবে প্রকাশিত হার্ভার্ড ম্যাগাজিনে জনাথন শ’ প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্ক লেহনারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। ‘পিরামিড দাসরা বানিয়েছিল’ প্রচলিত এই ভুল ধারণার বিপরীতে যুক্তি তুলে ধরেছেন তিনি।
মার্ক লেহনারের পিরামিড নির্মাণকারীদের বসবাসের শহর খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে লেখাটিতে পিরামিডের কারিগরদের জীবনযাপনের বেশ কয়েকটি দিক তুলে ধরা হয়েছে।
বিশেষ করে তারা সেখানে যে ধরনের খাবার খেতেন তা থেকে বোঝা যায় দাস বা সাধারণ কর্মী না, তারা ছিলেন ‘দক্ষ কারিগর’। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অ্যামেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ রিনজার পিরামিডের দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি দেখতে পান, যেখানে পিরামিড নির্মাণকারীদের ‘খুফুর বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিস্টার লেহনারের ধারণা, মিশরীয় সমাজ কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হতো, যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই শাসকের সেবা করতেন। মিশরীয়রা একে বলতো ‘বাক’।
সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে তাদের উপরে থাকা লোকদেরকে কোনও না কোনও ভাবে ‘বাক’ দিতে হতো। ‘কিন্তু এটা আসলে দাসত্ব হিসেবে বিবেচ্য হতো না’, বলেন মি. লেহনার। “এমনকি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও ‘বাক’ দিতে হতো”।
পিরামিড নির্মাণের খরচ অনেক বেশি হয়ে যাওয়ায় ফারাওরা শেষ পর্যন্ত ওল্ড কিংডম বা প্রাচীন সাম্রাজ্যের শেষের দিকে পিরামিড নির্মাণ বন্ধ করে দেয়। এছাড়া বিরাট আকারের পিরামিডগুলোতে ধন-সম্পদ পাওয়া যাবার কারণে মিশরীয়রা নিজেরাই সেগুলো লুট করে নিতো। পরে পিরামিড তৈরির বদলে ভ্যালি অব কিংসের গোপন সমাধিক্ষেত্রে ফারাওদের সমাহিত করা হতো।
পিরামিড নির্মাণের প্রচলিত ধারণার মধ্যে একটি ছিল শস্যের গুদাম হিসেবে এর ব্যবহার। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী, জোসেফকে তার ভাইয়েরা দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় এবং পরে ফারাওয়ের স্বপ্নের ব্যাখ্যার পর গুদামে খাদ্য সংরক্ষণ করে সাত বছরের দুর্ভিক্ষের হাত থেকে মিশরীয়দের বাঁচায়। বাইবেলে পিরামিডের কোনও উল্লেখ না থাকলেও মধ্যযুগের বিভিন্ন গল্পে এর উল্লেখ রয়েছে।
ষষ্ঠ শতাব্দীর ফ্রাঙ্কিশ বিশপ সেন্ট গ্রেগরি অফ ট্যুরসও এই ধারণা জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। জন ম্যান্ডেভিলের ১৪ শতকের জনপ্রিয় ভ্রমণ স্মৃতিকথায় ‘জোসেফের গুদাম ঘরের উল্লেখ করেন, যেখানে কঠিন সময়ের জন্য গম সংরক্ষণের’ বিষয়ে তিনি লিখে গেছেন।
কিন্তু রেনেসাঁর সময় থেকে যখন এ নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়, তখনই এই ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। “এখন অবশ্যই আমরা জানি যে পিরামিডগুলো মূলত সমাধি কক্ষ ছিল- যদিও সেটা অনেকগুলো বিষয়ের একটি। পিরামিডের স্থাপত্যে এর আগের এবং পরের সময়ের কাঠামো, ভেতরের সুড়ঙ্গপথ এবং সেখানকার জায়গার কার্যকারিতা থেকে মিশরের পরবর্তী সময়কে বোঝা যেতে পারে,” বলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশরবিদ অধ্যাপক জন ডার্নেল।
পিরামিডের ভেতরের প্রধান উপাদান পাথর ও ইট উল্লেখ করে তিনি বলেন, “স্বাভাবিকভাবেই সেখানে শস্যের জন্য খুব বেশি জায়গা থাকবে না এবং একইসঙ্গে এটি শক্তি ও প্রকৌশলের বিশাল অপচয় হবে”।
তাছাড়া প্রাচীন শস্যভাণ্ডারগুলো ছোট মৌচাক আকৃতির ছিল বলেও জানান তিনি। একইসঙ্গে জোসেফের গল্পটি সম্ভবত মিশরের মধ্য সাম্রাজ্যের সময়ের, যা কিনা গিজার পিরামিড তৈরির কয়েক শতাব্দী পরে বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক ডার্নেল।
আপনার মতামত জানানঃ