তার মতো নির্মম মহিলা ইতিহাস খুব কমই দেখেছে। ১৭৬৮ সালে ১৩৯টি খুনে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। মৃতদের সকলেই ছিলেন তার ক্রীতদাস। এ হেন ভয়ঙ্কর খুনির পরিণতিও ছিল ভয়ঙ্কর। আজও ডারিয়া নাকোলায়েভনা ইভানোভা সাল্টিকোভার কথা মনে করলে শিউড়ে ওঠেন রাশিয়ার মানুষ। শিশু, মহিলা-সহ অন্তত ১৩৯ জনকে খুন করেছিলেন সাল্টিকোভা। তাদের মধ্যে ৩৮ জনকে খুন করেছিলেন তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারেন এই ভয়ে। অভিজাত সামন্তপ্রভু সাল্টিকোভাকে যাবজ্জীবন দেয় মস্কোর আদালত। তার পর মস্কোর রেড স্কোয়্যারে তাকে নিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে এক ঘণ্টা মারধর করে সেনা।
বাকি জীবন মাটির নীচের একটি ঘরে চেন বাঁধা অবস্থায় কাটিয়েছিলেন সাল্টিকোভা। ১৮০১ সালের ২ নভেম্বর সেখানেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান তিনি। সাল্টিকোভার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে প্রায় ছ’বছর ধরে তদন্ত চলেছিল। তার এস্টেটের ক্রীতদাসদের সঙ্গে কথা বলে চমকে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। সাল্টিকোভার ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতেন তার ক্রীতদাসেরা। তার কথার অমান্য করলেই জুটত কড়া শাস্তি। এমনকি মৃত্যুদণ্ডও। সেই নিয়ে ক্রমে নানা ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। তবে মনে করা হয়, সেগুলির বেশির ভাগই কেবল ‘গল্প’। বাস্তবে তা ঘটেনি।
১৭৩০ সালে রাশিয়ার এক অভিজাত পরিবারে জন্ম সাল্টিকোভার। সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তার পরিবারের। লেখক লিয়ো টলস্টয়ের সঙ্গেও ছিল সুসম্পর্ক। রাশিয়ার বিত্তশালীরা সে সময় ইউরোপের দেশগুলি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিলেন। ইউরোপীয়দের মতো পোশাক, খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন। সাল্টিকোভাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ছোট থেকেই পরতেন ফরাসি, ইটালীয় পোশাক।
১৭৫০ সাল নাগাদ ২০ বছর বয়সে প্রশাসনের আধিকারিক গ্লেব আলেক্সেয়িভিখ সাল্টিকোভের সঙ্গে বিয়ে হয় সাল্টিকোভার। তখন ক্ষমতাশালী বৃত্তে যাতায়াত শুরু হয় সাল্টিকোভার। কথিত, রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের প্রেমিক ছিলেন গ্লেবের ভাই। অর্থাৎ সাল্টিকোভার দেওর। ক্যাথরিনের সন্তানদের পড়াতেন গ্লেবের ভাগ্নে। সাল্টিকোভার দুই ছেলে হয়। নাম থিওডোর এবং নিকোলাস। তাদের সঙ্গে যদিও খুব বেশি সময় কাটাতে পারেননি সাল্টিকোভা। ছেলেদের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৭৫৫ সালে অসুখে ভুগে মারা যান গ্লেব। ২৫ বছর বয়সে স্বামীকে হারান সাল্টিকোভা। দুই ছেলে, বিশাল জমিদারি, ভূসম্পত্তি আর ৬০০ ক্রীতদাসকে নিয়ে আতান্তরে পড়েছিলেন তিনি। বলা হয়, সেই চাপেই নাকি ধীরে ধীরে সাল্টিকোভার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটে। তিনি ক্রমে নির্মম হতে থাকেন। শোনা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর নিকোলে টিউটশেভের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন সাল্টিকোভা। এই নিকোলের নাতি কবি ফাইডর টিউটশেভ। তবে সাল্টিকোভাকে বিয়ে করেননি নিকোলে। বদলে অল্পবয়সি এক তরুণীর সঙ্গে পালিয়ে যান।
সে কথা শুনে নিকোলে এবং তার নববধূকে মারতে ক্রীতদাস পাঠিয়েছিলেন সাল্টিকোভা। কোনও মতে তারা পালিয়ে মস্কো চলে গিয়েছিলেন। তবে টিউটশেভের বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন সাল্টিকোভার ক্রীতদাসেরা। মনে করা হয়, এর পর থেকেই একের পর এক খুন করা শুরু করেন সাল্টিকোভা। কথিত, ক্রীতদাসীরাই নাকি তার নিশানা ছিলেন। ১৩৭ জন মহিলা এবং শিশু আর তিন জন পুরুষকে নাকি খুন করেছিলেন তিনি।
কেউ কেউ বলেন, এমনিতে সাল্টিকোভার আচরণ নাকি নম্রই ছিল। কিন্ত রাগলে মাথার ঠিক থাকত না তার। তখনই খুন করতেন। নিমেষে মেজাজ বদলে (মুড সুইং) যেত তার। অনেকে আবার বলেন, ক্রীতদাসদের ‘শিক্ষা’ দিতে গিয়েই খুন করতেন তিনি। কী ভাবে খুন করতেন সাল্টিকোভা? এই নিয়েও রয়েছে বহু গল্প। বলা হয়, ক্রীতদাসদের লক্ষ্য করে জিনিস ছুড়তেন তিনি। কোনও ক্রীতদাস কথা না শুনলে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পেটের উপর উঠে দাঁড়াতেন। রাশিয়ার চরম ঠান্ডায় রাতে নগ্ন করে বার করে দিতেন ক্রীতদাসীদের।
কখনও ক্রীতদাসীদের মাথায় ঢেলে দিতেন ফুটন্ত জল। কখনও নগ্ন করে চাবুক মারতেন, যত ক্ষণ না পিঠের চামড়া উঠে আসে। কখনও কেটে দিতেন কান। শোনা যায়, এক বার এক ক্রীতদাস নিজের স্ত্রীকে খুনের ছক কষেছিলেন। জানতে পেরে চুপ করে বসেছিলেন সাল্টিকোভা। স্ত্রীকে খুনের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন সেই ক্রীতদাস। সেই নববধূকে খুন করেন সাল্টিকোভা। তার তৃতীয় স্ত্রীকেও একই ভাবে খুন করেন।
সাল্টিকোভার এই নির্মমতা নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয় রাশিয়ায়। শাসক ক্যাথরিনের কানেও যেত অনেক কথা। কিন্তু ক্ষমতার জোরে সব ধামাচাপ দিতেন সাল্টিকোভা। ঘুষ দিয়ে হাতে রাখতেন প্রশাসকদের। ১৭৬২ সালে সাল্টিকোভার কয়েক জন ক্রীতদাস পালিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে পৌঁছন। সেখানে গিয়ে ক্যাথরিনের কানে খবর দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সেই দাস, যিনি তিন স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে ক্যাথরিন চাপে পড়ে সাল্টিকোভার বিচার শুরু করান। তাতে যাবজ্জীবন হয় তার। মাটির তলার ঘরে চেনে বাঁধা অবস্থায় কাটে তার বাকি জীবন।
আপনার মতামত জানানঃ