আমরা গাজায় যে বিপর্যয় ঘটতে দেখছি, তা গণহত্যার দিকে মোড় নিচ্ছে। এটা কোনো ‘আক্রমণ’ নয়। দখল নয়। কোনো যুদ্ধ নয়। পুরোদস্তুর গণহত্যা। গাজায় কেয়ামতের মতো যেসব দৃশ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা দখলদার নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর আসল উদ্দেশ্য কী, তার প্রমাণ। তারা আগেই বিপর্যস্ত এই একটুকরা জমির দখল চায়। এ জন্য নির্বিচারে অসহায়, বিপর্যস্ত শিশু, নারী ও পুরুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
দশকের পর দশক পশ্চিমা দেশগুলোর সম্মতি ও অনুপ্রেরণায় ইসরায়েল সরকার এবং তাদের উন্মত্ত সহযোগী বসতি স্থাপনকারীরা একটু একটু করে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই নির্মম স্বভাবের মিত্রের প্রতি সংহতি জানিয়ে পশ্চিমারা তাদের পর্যটনস্থলগুলো নীল-সাদা অথবা স্টার অব ডেভিডে সজ্জিত করেছে।
এগিয়ে যাও, কাপুরুষ আর তাদের দোসরেরা। পৃথিবীকে তোমাদের প্রকৃত রং-রূপ দেখাও। আমরা তোমাদের মনে রাখব। ভুল করবেন না। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর জাতিবিদ্বেষী মন্ত্রিসভার সদস্যরা বহুদিন ধরেই ‘চলো ফিলিস্তিনিদের প্রাণঘাতী সহিংসতার মজা দেখাই’, এই পথ ছেড়ে গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে চাইছিলেন।
এই দানবীয় পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর। তাঁর মতো ঘৃণিত মানুষই পারেন পৃথিবীর বুক থেকে গাজাকে মুছে দিয়ে গাজা শেষ করা। যে কেউ যেকোনো জায়গা, যেকোনো ফোরামে যদি এই কথা অস্বীকার করেন, তাহলে বলতে হবে তিনি মিথ্যাবাদী, অন্ধ অথবা দুই-ই। এটা ন্যায়সংগত কোনো জবাব বা প্রতিশোধ নয়, যাঁরা কখনোই ফিলিস্তিনিরা যে অন্তহীন দুর্দশা দেখেননি বা গ্রাহ্য করেননি, আমি আবারও সেই সব সেনাসদস্যের উদ্দেশে বলতে চাই, এটা গণহত্যা।
আমার এই কাঠখোট্টা অভিযোগ যদি আপনাদের বিঁধে থাকে, তাহলে আমি আমেরিকার মূর্খ সংবাদ তারকা, কলাম লেখকদের চ্যালেঞ্জ করতে চাই। সাংবাদিকেরা যাঁরা সেজেগুজে ইসরায়েলে যান ও নিজেদের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংবাদদাতা বলে প্রচার করেন তাঁদের বলি, আমাকে ও দেশের বাইরে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী ও তাদের মিত্রদের ভুল প্রমাণ করুন। তাঁরা বলছেন, অবরুদ্ধ গাজায় গণহত্যা শুরু হয়েছে। এই ভণ্ডরা আবার ফিলিস্তিনিদের হানাদার আর ইসরায়েলিদের সন্ত বলে আখ্যা দিচ্ছে। কারণ, গণহত্যার আগে তারা গাজাবাসীকে আগাম বার্তা দিয়েছে।
কূটনীতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের সমস্যা সমাধান নিয়ে তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে তাগিদ, তার বাইরে আসল ঘটনা হলো, এই বর্বরতা একটা শেষের দিকে এগোচ্ছে। গাজার প্রতিটা ইঞ্চির মতো গাজাবাসীকে ও তাঁদের স্মৃতি ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হলো এবারকার উদ্দেশ্য।
ইসরায়েলের এই ধামাধরা অনুগত লোকজন কখনো গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে যাননি। ক্ষতি, চুরি, বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান আর জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রের প্রাণঘাতী হামলা সহ্য করে যে লাখ লাখ মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে কোনোরকমে বেঁচে আছে, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কোনো চেষ্টাও করেননি। তাঁরা যা করছেন তা হলো, জটিল একটি গল্পকে কালো ও সাদাদের মধ্যকার বিরোধের মতো করে অনভিজ্ঞ ও ভূগোলের জ্ঞান না থাকা মার্কিনিদের কাছে উপস্থাপন করে আসছেন। ইসরায়েলিরা সব সময় নিষ্পাপ, তাঁরা ভুক্তভোগী। ফিলিস্তিনিরা সব সময় দোষী, ষড়যন্ত্রকারী।
কাজেই জীবন বাঁচাতে যা দরকার—খাবার ও পানি—অবরুদ্ধ গাজায় প্রবেশ বন্ধ করে দিন। বাসাবাড়ি ও হাসপাতালে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিন। জাতিসংঘের যে স্কুলগুলোতে দিশাহারা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো বোমা হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ওপর বোমাবর্ষণ করুন। বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন শিশুদের নিয়ে অন্ধকার হাসপাতালের দিকে ছোটা অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করুন। সাদা ফসফরাস বর্ষণ করুন, যেন ফিলিস্তিনিদের হাড় পর্যন্ত পুড়ে যায়। গুজব ছড়াতে থাকুন যে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালানো হচ্ছে। আদতে গাজাকে ২০০৫-এর ফালুজাতে রূপান্তরের চেষ্টা হচ্ছে।
‘গাজা’ নামক কারাগারের ফটক শক্ত করে বন্ধ করে দিন, যেন এই দশা থেকে কেউ মুক্তি না পায়, কোনো আশা যেন না থাকে। তারপর ১০ লাখের ওপর মানুষকে গাজা ছাড়ার নির্দেশ দিন, যা পালন না করলে মৃত্যু নিশ্চিত। লম্বা এই তালিকায় যুক্ত আছেন ‘ভালো মানুষের’ চেহারা নিয়ে বসে থাকা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা, যাঁরা শুধু ফিলিস্তিনিদের হামলাকে নিন্দা করেন আর ইসরায়েলিদের হামলা, ধ্বংসযজ্ঞকে স্বাগত জানান।
তাই অনুগ্রহ করে কল্পনার জগতে থাকা মানুষ এবার হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) ইসরায়েলসহ দুই পক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য কাকুতি-মিনতি বন্ধ করুন। কারণ আইসিসি জানে, ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে থেকে যাঁরা এই মিথ্যার বেসাতি করছেন, তাঁদের মনে আঘাত দেওয়া ঠিক হবে না, উচিত নয়।
এদিকে নেতানিয়াহু—কয়েক সপ্তাহ আগেও দুর্নীতি, ঘুষ এবং বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে যাঁর কঠোর সমালোচনা হয়েছিল, যাঁর শরীরে কর্তৃত্ববাদের ডিএনএ আছে, তাঁকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর অনুগত সমর্থকের দল আবার পুনর্বাসিত করেছে। তাঁরা বললেন, এই নেতানিয়াহু নাকি মধ্যপ্রাচ্যে সহনশীলতা ও নৈতিকতার পরম পরাকাষ্ঠা।
এমনই রোগাক্রান্ত নৈতিক চেহারা বাইডেন এবং লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, ব্রাসেলস, ক্যানবেরা ও অটোয়ায় তাঁর মিত্রদের। কিন্তু এতে বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বর্বর ঔপনিবেশিকেরা, যাদের নিজেদেরই নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলার ইতিহাস আছে, তারা ফিলিস্তিনে অপর একটি ঔপনিবেশিক শক্তির হত্যা, নির্যাতনকে সমর্থন করবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাইডেন ও অন্যরা যে লাখ লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের পক্ষে কথা বলছেন না। তাঁরা কিন্তু ঠিকই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির প্রতি ধারাবাহিকভাবে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে যাবেন।
কূটনীতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের সমস্যা সমাধান নিয়ে তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে তাগিদ, তার বাইরে আসল ঘটনা হলো, এই বর্বরতা একটা শেষের দিকে এগোচ্ছে। গাজার প্রতিটা ইঞ্চির মতো গাজাবাসীকে ও তাঁদের স্মৃতি ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হলো এবারকার উদ্দেশ্য।
দুটি পৃথক দেশের ধারণা অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের কৈফিয়তদাতাদের মতো বিলাসী, আইভি-লিগ শিক্ষিতদের অসম্ভব কল্পনা। ব্লিঙ্কেন তাঁর ‘বসের’ নির্দেশে গণহত্যার সবুজ সংকেত দিতে ইসরায়েলে গেছেন। আমরা তা-ও মনে রাখব।
আমরা আরও ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে দেখব। কিন্তু ওতে ফিলিস্তিনিরা ভেঙে পড়বেন না। তাঁরা টিকে থাকবেন। হয়তো ফিরে আসাটা কঠিন, সময়সাধ্য। তবে তাঁরা পুনর্নির্মাণ করবেন।
আপনার মতামত জানানঃ