ভারতের রাজধানীতে একটি সরু গলিতে তার বাড়ির বাইরে বসে, মোহাম্মদ ওয়াজিদ তার ২২ বছর বয়সী ছেলেকে হত্যার ঘটনাটি একজন টিভি সাংবাদিকের কাছে বর্ণনা করছিলেন। নয়াদিল্লির সুন্দর নাগরী এলাকায় তাদের ঘরের ভিতরে বসেছিলেন নিহত মোহাম্মদ ইসহাকের চার বোন
আমি সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি,” ইসহাকের বাবা আব্দুল ওয়াজিদ আল জাজিরাকে বলেছিলেন যখন তার চোখ অশ্রুতে ভরে যায় ওঠে এবং তার কণ্ঠ ভেঙ্গে আসে। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে ইসহাককে একটি লোহার খুঁটির সাথে একটি চামড়ার বেল্ট দিয়ে বেঁধে নির্দয়ভাবে মারধর করা হয় এই সন্দেহে যে, সে ‘প্রসাদ’ চুরি করেছে। ইসহাকের বাসা থেকে তিন লেন দূরে এ ঘটনা ঘটে। ‘আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে কারণ সে প্রসাদ খেয়েছিল,’ ওয়াজিদ (৬০) বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে তারা এটাকে আপত্তিকর মনে করেছে যে একজন মুসলমান তাদের প্রসাদ স্পর্শ করেছে।’
প্রসঙ্গত, ভারতের খোদ রাজধানীতে মন্দির থেকে একটি কলা নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে ২২ বছর বয়সী এক মুসলিম যুবককে বর্বর নির্যাতন করে হত্যা করেছে উগ্র হিন্দুরা।
নয়াদিল্লির সুন্দর নাগরি এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইশরাককে গত মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে উগ্র কিছু হিন্দু এ নির্যাতন চালায়। তারা তাকে লোহার একটি খুঁটিতে চামরার বেল্ট দিয়ে বেঁধে বেধড়ক মারপিট করতে থাকে। সংজ্ঞাহীন না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে বর্বরতা।
হিন্দু গণেশ চতুর্থি অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে। যেখানে ইশরাকের ওপর বর্বরতা চালানো হয়, সেটি তার বাসা থেকে তিন লেন পরে অবস্থিত।
চার বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন ইশরাক। নিহতের এক বোন উজমা আলজাজিরাকে বলেছেন, মন্দির থেকে একটি কলা নিয়ে আসার অভিযোগে তার ভাইকে এমন বর্বরভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি জানান, বেধড়ক পিটুনির পর তার ভাইয়ের নখ তুলে নেয়া হয়, পরে আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলা হয়।
‘মুসলমান হওয়ার কারণেই তার ভাইকে এমন নির্যাতন করা হয়,’ বলেন উজমা।
উজমা আরো জানান, তার ভাইকে নির্যাতনের পর রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। পরে তাদের এক প্রতিবেশী ছেলে তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। এ সময় ইশরাক কোনো কথা বলতে পারছিল না, অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন ছিল। তার কিছুক্ষণ পরই মৃত্যু হয় ইশরাকের।
এদিকে, পুলিশ বলছে, তারা ইশরাকের মৃত্যুর পর বিষয়টি জানতে পারেন।
এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। জনগণ এ নির্মমতার বিচার চেয়েছেন। এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে।
স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা জয় এন টিরকি এক ভিডিও বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তদন্তে জানা গেছে যে একদল লোক ইশরাককে চোর হিসেবে সম্বোধন করে আটক করে এবং পরে তাকে বেঁধে মারধোর করে।
তবে, প্রতিবেশীরা বলেছেন, ইশরাক মানসিকভাবে কিছুটা প্রতিবন্ধী ছিলেন। ইশরাকদের একই লেনে বসবাস করা অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ সালিম বলেন, ‘সে (ইশরাক) খুব সাধাসিধা ছেলে ছিল। সে কখনো কারো কোনো ক্ষতি করতো না। বরং কেউ কোনো কাজের কথা বললে সে তাৎক্ষণিক এগিয়ে যেত।’
ইশরাকের সবজি বিক্রেতা বাবা আব্দুল ওয়াজিদ ছেলে হত্যার বিচার চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশী তৎপরতায় আমরা খুশি। তবে আমরা চাই যারা আমার ছেলেকে মেরেছে, তাদেরও একই পরিণতি হোক।’
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির ডানপন্থী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকে নির্যাতন ও গণপিটুনি, বিশেষত মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ব্যাপকহারে বেড়েছে।
গো-হত্যার অভিযোগে উগ্র হিন্দুদের নির্যাতনে প্রাণ হারিয়ে কয়েক ডজন মুসলমান। নয়াদিল্লিভিত্তিক মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিস্ট সারজিল উজমানি বলেছেন, ইশরাক হত্যাকাণ্ডে হিন্দুদের একটি গোষ্ঠীর ধর্মীয় গোড়ামির অন্ধকার দিক ফুটে উঠেছে।
তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের হত্যা করা যেন একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। হিন্দু নেতাদের এটা নিয়ে ভাবতে হবে।’
আপনার মতামত জানানঃ