ভারতের সাথে বাণিজ্যে রুপিতে লেনদেনের জন্য বাংলাদেশের আরো দুইটি বেসরকারি ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন অনুমতি পাওয়া ব্যাংক দুইটি হচ্ছে – ইসলামি ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
এর আগে চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে রুপির ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক শুরুতে সোনালি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডকে এই কার্যক্রমে যুক্ত করে।
যদিও চুক্তি অনুযায়ী টাকা ও রুপি দুটি মুদ্রা ব্যবহার করেই লেনদেনের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে দুই দেশ, তবে আপাতত শুধু রুপিতেই লেনদেন হচ্ছে। তবে জুলাই মাসে এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক শুরু হলেও, মাত্র গত সপ্তাহেই রুপি ব্যবহার করে আমদানি ও রপ্তানি করেছে বাংলাদেশের দুটি কোম্পানি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারত থেকে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।
বিপরীতে দুই বিলিয়ন বা দুইশো কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আর শুধুমাত্র এই রপ্তানির অঙ্কটাই রুপিতে লেনদেন করা যাবে, এর বাইরে আমদানির বাকি অর্থ শোধ করতে হবে ডলারে। কিন্তু রুপিতে লেনদেনের এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কতটা কাজে আসছে?
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
ব্যবসায়ীরা সাধারণভাবে মনে করেন, রুপিতে লেনদেনের ব্যবস্থা হওয়ায় আপাতত তাদের ডলার নির্ভরতায় খুব কম পরিমানে হলেও চাপটা কিছুটা কমেছে।
তারা বলছেন, এ ব্যবস্থা কিছুটা হলেও তাদের জন্য ডলারের একটা বিকল্প তৈরি হয়েছে। তবে এর পুরো সু্বিধা নিতে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়াতে হবে বলছেন তারা।
এই মূহুর্তে বাংলাদেশের দুইটি প্রতিষ্ঠান ভারতের সাথে রপ্তানির ক্ষেত্রে রুপিতে বাণিজ্য করছে – প্রাণ গ্রুপ এবং ওয়ালটন গ্রুপ। এই দুইটি প্রতিষ্ঠানেরই পণ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে ভারতের বাজারে।
এর মধ্যে প্রাণ মূলত তাদের ফুড আইটেম ভারতে রপ্তানি করে, প্রতিষ্ঠানটির পণ্য ভারতের ২৮টি রাজ্যে গেলেও, প্রাণের উৎপাদিত পণ্যের বড় বাজার দেশটির সেভেন-সিস্টার নামে পরিচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে। আর ভারত থেকে প্রাণ প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের কাঁচামাল আমদানি করে।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা ভারতে নিয়মিত পণ্য রপ্তানি করি, এবার আমরা রুপিতে পেমেন্ট পেলাম। সেটা দিয়ে আবার এলসি কিনে আমদানিও করলাম।”
অন্যদিকে, সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে রুপিতে ভারতের সাথে বাণিজ্য করেছে ওয়ালটন। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় রেফ্রিজারেটর এবং নানা ধরণের বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যান রপ্তানি করে। গত বছর মানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন লাখ রেফ্রিজারেটর ভারতে রপ্তানি করেছে ওয়ালটন।
এছাড়া ভারত থেকে বিভিন্ন পন্যের কাঁচামাল আমদানি করে তারা। ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর বিভাগের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, শুরুতে একটু বেগ পেতে হলেও তিনি মনে করেন সময়ের সাথে এই পদ্ধতি আরও সহজ হয়ে উঠবে।
“নতুন প্রসেস, তাই শুরুটা সহজ ছিল না। আমাদের প্রায় এক থেকে দেড় মাস গিয়েছে, দুই দেশেই অনেক অনুমতির ব্যাপার ছিল। তবে এখন হয়তো আর এত সময় লাগবে না।”
ব্যাংক কী বলছে
প্রথমবারের মতো রুপিতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রাণ গ্রুপ ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড-ইবিএলের মাধ্যমে লেনদেন করেছে। ইবিএলের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ শাহীন নতুন ব্যবস্থাকে একটি ‘ব্রেকথ্রু’ বলে বর্ণনা করে বলছেন, খুব সামান্য পরিমাণ হলেও এটা ডলার থেকে বের হওয়ার একটা সুযোগ।
তিনি বলেছেন, “আমাদের ৯৮ শতাংশের উপরে লেনদেন হয় ডলারে। এখন পরিবর্তিত বৈশ্বিক অবস্থায় এটার একটা বিকল্প দরকার। আবার হঠাৎ করে ডলার থেকে সরা যাবে না। সেক্ষেত্রে এটা (রুপিতে লেনদেন) একটা উইন্ডো ওপেন হল বলতে পারেন।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বিশ্বব্যাপী নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক দেশেই নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের দিকে ঝুঁকেছে। এই মূহুর্তে ভারত ২২টি দেশের সাথে রুপিতে লেনদেনের জন্য ভস্ত্রো অ্যাকাউন্ট খুলেছে, যার সর্বশেষটি হল বাংলাদেশ।
ভস্ত্রো অ্যাকাউন্ট হল দেশের ব্যাংকে অন্য আরেকটি দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, যাতে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করা যায়, ডলারে রুপান্তর করতে হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন, প্রথমে দুটি, পরে বাংলাদেশের আরো দুটি ব্যাংকে ভারতের ব্যাংক ভস্ত্রো অ্যাকাউন্ট খোলে। এবং আরও বেশকটি ব্যাংক এক্ষেত্রে পাইপলাইনে আছে।
“আমাদের মাত্র এটা শুরু। এখন এক্সপোর্টার-ইমপোর্টার দুই পক্ষরই এতে অভ্যস্ততার বিষয় আছে। একটা সময় আসবে যখন মানুষ এরকম লেনদেনে আরও আগ্রহী হবে।”
শুরুতে দুই দেশই এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পার করেছে বলে জানিয়েছন সংশ্লিষ্টরা ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ী উভয় পক্ষ।
রুপিতে যেসব সুবিধা
প্রাণ গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ কর্তা ইলিয়াস মৃধা বলছিলেন, অনেক ব্যাংক ডলার ক্রাইসিসের কারণে এলসি দিতে দেরি করছে।
“কিন্তু যখন বলছি রুপিতে করবো তখন এলসি দ্রুত খুলে দিচ্ছে। আমি মনে করি ডলারের চাপ কমাতে এটা উপকার হবে।”
রুপিতে লেনদেনের তাই বড় সুবিধা হল ডলারের বিকল্প একটা মুদ্রা হাতে থাকা। এছাড়া এটি মুদ্রা পরিবর্তনের একটি ধাপ কমিয়ে দিচ্ছে। এতদিন ব্যবসায়ীদের টাকা থেকে ডলার করে, তারপর সেটা ভারতে আবার রুপিতে পরিবর্তন করতে হত।
কিন্তু এখন এটা টাকা থেকে সরাসরি রুপিতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে একটা এক্সচেঞ্জ রেট কমে গেল। যা আগের থেকে কিছুটা লাভজনক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে যারা ভারতের সাথে আমদানি-রপ্তানি করে থাকেন, তারা এর সুবিধাটা সবচেয়ে বেশি পাবেন বলে মনে করেন ওয়ালটনের কর্মকর্তা মি. তোফায়েল।
ওয়ালটন রেফ্রিজারেটরের প্রধান এই বাণিজ্যিক কর্মকর্তা বলছেন, “আমরা বড় অঙ্কের কাঁচামাল ভারত থেকে নিয়ে আসি। সেখানে ডলারে পেমেন্ট করা লাগতো। কিন্তু এখন রপ্তানি থেকে যে রুপিটা পেলাম সেটা দিয়েই আমরা পেমেন্ট করছি। কারেন্সি পরিবর্তনের দরকার পড়ছে না।”
ইবিএল ব্যাংকের কর্মকর্তা আহমেদ শাহীন অবশ্য বলেন্র, যে কোন রপ্তানি বা আমদানিকারকই রুপিতে লেনদেনের সুবিধা নিতে পারবেন চাইলে।
“দেখুন ব্যাংক তো হোলসেলার, এখন আপনি কিছু এক্সপোর্ট করবেন, আপনার প্রাপ্ত রুপিটা দিয়ে আমি আরেকটা ইমপোর্ট সেটেল করবো, আর আপনি ব্যাংক থেকে রুপির সমপরিমাণ টাকা উঠিয়ে নেবেন।”
রুপির চ্যালেঞ্জ যেখানে
ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি হল প্রায় সাত গুণ; আর এটাই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে রুপিতে লেনদেনের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ বলছে বাংলাদেশের ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা।
হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ যে দুইশো কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে, সেই সমপরিমাণ রুপি তারা আমদানির ক্ষেত্রে পরিশোধ করতে পারছে। কিন্তু বাকি যে আরও ১২০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করতে হয় সেটা পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারেই। অন্য কোথাও থেকে রুপি কিনে এই লেনদেনের সুযোগ নেই।
অবশ্য ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে বলে মত তার। তবে এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোন বিকল্প দেখছে না ব্যবসায়ীরা। আরও বেশি করে রপ্তানিতে নজর দেয়ার কথা বলছে ওয়ালটন এবং প্রাণ – দুই প্রতিষ্ঠানই।
আপনার মতামত জানানঃ