শেষ সম্বল বিক্রি করে সৌদি আরবে পাড়ি জমানো বাংলাদেশি নারীরা সৌদি নিয়োগকর্তার লিপ্সার শিকার হওয়ার পাশাপাশি স্বদেশিদেরও যৌনলিপ্সার শিকার হচ্ছেন খোদ দূতাবাসের ভেতরেই। যে দূতাবাস সার্বভৌমত্বের প্রতীক, বিদেশ-বিভুঁইয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ সেখানেই তারা সম্ভ্রম হারিয়ে দেশে ফিরছেন। এমন ঘটনা বিরল কিছু নয়। একজন বা দুজন নয়, একাধিক নারী একই কর্মকর্তার কাছে যৌননিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে গিয়ে নির্যাতনের শিকার নারীদের রাখা হতো দূতাবাসের সেফহোমে। দূতাবাসের কাউন্সেলর হিসেবে সেই নারীদের অপ্রয়োজনে ডেকে পাঠাতেন। একান্ত সাক্ষাৎকারের নামে তাদের অশ্লীল প্রশ্ন করতেন। বিভিন্নভাবে হেনস্তা এবং ধর্ষণও করেছেন।
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফহোমে এই আশ্রিত গৃহকর্মীদের যৌন নির্যাতনের (ধর্ষণ) দায়ে উপ-সচিব মো. মেহেদী হাসানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে মেহেদী হাসান কাউন্সেলরের দায়িত্বে থাকার সময় এ অভিযোগ উঠেছিল। এর আগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, দূতাবাসের সেইফহোমে আশ্রিত কতিপয় গৃহকর্মীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় মেহেদী হাসানকে ওই পদ থেকে ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি অবমুক্ত করা হয়।
এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে অসদাচরণের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দিয়ে ওই বছরের ১০ মার্চ কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
২০২১ সালের ৮ এপ্রিল লিখিতভাবে কারণ দর্শানোর জবাব দাখিল করে ব্যক্তিগত শুনানি চান মেহেদী হাসান। ব্যক্তিগত শুনানিতে দাখিল করা জবাব ও বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে ওই বছরের ২০ জুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, তদন্তে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে দূতাবাসের সেইফহোমে আশ্রিত কতিপয় গৃহকর্মীকে অপ্রয়োজনীয় একান্ত সাক্ষাৎকারের নামে অশ্লীল প্রশ্ন ও আচরণসহ বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা এবং যৌন নির্যাতন (ধর্ষণ) করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
‘তদন্ত প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী মেহেদীকে গুরুদণ্ড দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ওই নোটিশে কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অন্য কোনো গুরুদণ্ড দেওয়া হবে তা জানতে চাওয়া হয়।’
দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর জবাবে অভিযোগের বিপরীতে মেহেদী কোনো সন্তোষজনক বক্তব্য দিতে সক্ষম হননি জানিয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ফলে মেহেদীর দাখিল করা জবাব ও তদন্ত প্রতিবেদনসহ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের গুরুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ চাওয়া হলে কমিশন সহমত পোষণ করে। পরে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে মেহেদী হাসানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
প্রকৃত পক্ষেই এখানেই শেষ নয়। সৌদি আরবে প্রবাসী নারীদের নির্যাতনের শিকার হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা দূতাবাস হোক কিংবা স্থানীদের দ্বারা হোক। কিন্তু কোন প্রতিকার কেন নেই? কেন করা যায় না প্রতিরোধ?
আইন কোথায়?
প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি নারী কাজ করেন তাদের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই৷ একটিই আইন আছে বাংলাদেশে৷ ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক আইন৷ কিন্তু এই আইনে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্টদের ধরা যায়, সৌদি আরবে নির্যাতনের কোনো প্রতিকার করা যায় না৷ আইন অনুযায়ী, কেউ যদি প্রতারণার শিকার হন, শর্তভঙ্গ হয়, নির্যাততিত হন, তাহলে দাযিত্ব হলো রিক্রুটিং এজেন্সির৷
এখানে সাজা ও ক্ষতিপুরণের বিধান আছে৷ তবে এই আইনের বিধিগুলো অস্পষ্ট৷ যদি কেউ নির্যাতনের বা প্রতারণার অভিযোগ করে, তাহলে নিস্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগে৷ আরেকটি আইন আছে ২০১৭ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন৷ সেটাও এখানকার জন্য৷
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘‘সৌদি আরবে যে নারীরা যান, তাঁরা গৃহকর্মী হিসেবে বাসাবাড়িতে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রটিই সমস্যার, কারণ, সেখানে যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তা গৃহকর্তার দ্বারাই হন৷ সৌদি আইনে গৃহকর্তাকে বিশেষ অধিকার দেয়া আছে৷ সেখানে বিদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের প্রটেকশনের কোনো আইন নেই৷”
তিনি জানান, জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই৷ পাঠানো হয় সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে৷ স্মারকেও দুর্বলতা আছে৷ যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও এটা আরেকটু শক্ত করা যেতো যে ওখানে গিয়ে কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে যেন ওখানকার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেটাও করা হয়নি৷
আর নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো নারী যখন এমন অবস্থায় উপনীত হয়, ওই দেশ ছেড়ে আসতে পারলেই সে তখন বেঁচে যান৷ আর ওখানে সে থাকবেই বা কিভাবে৷ থেকে যদি মামলা করেও, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা কোথায়?
তিনি আরো বলেন, আমাদের যে আইন আছে তাতে বিএমইটি হয়তো ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে পারে, কিন্তু নির্যাতনের বিচার তো করতে পারে না৷
এই পরিস্থিতি কেন?
বিশ্বের ২৯টি দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে লেবার এটাশে আছে৷ এটা সৌদি আরবেও আছে৷ সেখানে সেফ হোমও আছে৷ তারপরও পরিস্থিতি এত খারাপ কেন?
এ প্রসঙ্গে বিএমইটি’র পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান বলেন, যারা নির্যাতনের বা প্রতারণার শিকার হয়, তারা ওইসব দেশে ফৌজদারি মামলা করতে চায় না, কারণ, ফৌজদারি মামলা করলে মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয়৷ এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না৷ আমাদের দূতাবাসগুলো তাদের রাখার ব্যবস্থাও করতে পারে না৷
তাছাড়া তাদের আকামার সময়ও শেষ হয়ে যায়৷ তারা ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করে৷ এটা দ্রুত সম্ভব, যদি প্রমাণ করা যায়৷ আর আমরা ২০১৩ সনের আইনে যেটুকু কাভার করে, সেটুকুই করি৷ আমরা রিক্রুটিং এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি৷
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের কোনো শ্রমিক নির্যাতনে মৃত্যুর পর সেখানে কোনো মামলা হয়েছে এমন কোনো নজির এ পর্যন্ত নেই৷ যদি হত্যার ঘটনা প্রমাণ করা যায়, তাহলে ওই দেশের আইনে মামলা হয়৷ কিন্তু প্রমাণ করা যায় না৷
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৮
আপনার মতামত জানানঃ