ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী জোর করে একটি মসজিদে ঢুকে মুসলিমদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করিয়েছে, রাজ্যের অন্তত তিনজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এই অভিযোগ তোলার পর রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেছে।
পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী মেহবুবা মুফতি গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রথম টুইটারে এই অভিযোগ তোলেন।
এর পরদিন আরও দুজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, ওমর আবদুল্লাহ ও গুলাম নবি আজাদও বলেন এরকম ঘটনা ঘটে থাকলে তা চরম নিন্দনীয় এবং দাবি জানান যে দোষীদের কঠোর সাজা দিতে হবে।
তবে এই অভিযোগ সামনে আসার পর প্রায় দু’দিন কেটে গেলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী এই অভিযোগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। সেনা মুখপাত্র যেমন ঘটনাটি স্বীকার করেননি, তেমনি অস্বীকারও করেননি।
শ্রীনগরে বিবিসির সংবাদদাতা মাজিদ জাহাঙ্গীরকে সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র পর পর দু’দিন জানিয়েছেন এরকম কোনও ঘটনা ঘটেছে বলে তাদের জানা নেই, তবে তারা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নেবেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাও জানাচ্ছে, তাদের সংবাদদাতা যখন এই বিষয়ে জানতে কাশ্মীরের সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের ফোন করেছিলেন তারা হয় জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন, নয়তো ফোনই ধরেননি।
যা ঘটেছে
তবে পুলওয়ামার যে জাদ্দোরা গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছে বলে বলা হচ্ছে, সেই গ্রামের সিভিল সোসাইটি গ্রুপের চেয়ারম্যান আলতাফ আহমেদ ভাট দাবি করেছেন রবিবার (২৫ জুন) শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তারা তাদের গ্রামে এসে ওই ঘটনার জন্য দু:খ প্রকাশ করে গেছেন।
কলকাতার ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা ভাটকে উদ্ধৃত করে আরও জানাচ্ছে, সেনাবাহিনীর যে মেজরের নেতৃত্বে ওই ঘটনা ঘটেছিল তাকেও তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সেনা কর্মকর্তারা গ্রামবাসীদের জানিয়েছেন।
তবে সেনাবাহিনীর সূত্রে এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। কারণ তারা বিষয়টি নিয়ে মুখে পুরোপুরি কুলুপ এঁটে রয়েছেন।
মেহবুবা মুফতি শনিবার সন্ধ্যায় টুইট করেন, “৫০ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের সেনারা পুলওয়ামাতে একটি মসজিদে জোর করে ঢুকে পড়েছে এবং তার ভেতরে মুসলিমদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করেছে – এ খবর শুনে আমি স্তম্ভিত।”
অমরনাথ যাত্রার ঠিক আগে এবং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন নিজে কাশ্মীরে আছেন, তখন এধরনের একটি ঘটনা ‘প্ররোচনা’ ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মিস মুফতি মন্তব্য করেন।
তবে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ জাদ্দোরা গ্রামে সেদিনের যে ঘটনাক্রম বর্ণনা করেছে, তা রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো।
আলতাফ আহমেদ ভাট ওই পত্রিকাটিকে জানান, শনিবার ভোররাতে প্রায় দুটো নাগাদ একদল সেনা তাদের গ্রামে আসে এবং তাকে ডেকে তুলে আরও কয়েকজন গ্রামবাসীকে খবর পাঠাতে বলে।
গ্রাম থেকে বেরোনোর সব রাস্তা বন্ধ করে এরপর রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেশ কয়েকজনকে তুলে আনা হয়। এদের মধ্যে ভাটের ভাই জাভেদ আহমেদও ছিলেন, যিনি পেশায় একজন সরকারি স্কুলশিক্ষক।
আলতাফ আহমেদ ভাট আরও বলেন, “এরপর আমি তাদের চিৎকার ও কান্নাকাটির আওয়াজ পাই। আমি বুঝতে পারি যে তাদের মারধর করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ জানাতে গেলে সেনা জওয়ানরা আমাকে চুপ করতে বলে।”
“পরে আমি জানতে পারি – গ্রামবাসীদের বলা হয়েছিল মসজিদের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে তাদের জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে হবে। তারা আপত্তি জানালে তাদের বেধড়ক পেটানো হয়।”
তার স্কুলশিক্ষক ভাই যখন সেনাদের জানান, বাইরে দাঁড়িয়ে বললেও মসজিদের ভেতরে গিয়ে তিনি কিছুতেই জয় শ্রীরাম বলতে পারবেন না – তখন তার মাথা চেপে ধরে সেনা সদস্যদের দেওয়ালে ঠুকে দিতেও দেখেন আলতাফ আহমেদ ভাট।
এর ঘন্টাদেড়েক বাদে মসজিদের মুয়াজ্জিন যখন আজান দিতে সেখানে আসেন, তাঁকেও পাকড়াও করে সেনা সদস্যরা লাউডস্পিকারে ঠিক আজানের সুরে সুরে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করে।
কয়েকশো মিটার দূরে গ্রামের আর একটি মসজিদ, জামিয়া মসজিদেও ততক্ষণে সেনা জওয়ানরা পৌঁছে গেছেন এবং সেখানেও তারা ঠিক একই জিনিস করেন।
তিনি জানান, “ওখানেও দৌড়ে পালাতে যাওয়া মুয়াজ্জিন শিরাজ আহমেদকে ধরে এনে অন্য নামাজিদের সঙ্গে জয় শ্রীরাম বলানো হয়।”
সেনা কমান্ডার না কি যাওয়ার আগে এই হুমকিও দিয়ে যান, আসন্ন ঈদ-উল আজহায় তাদের অনুমতি ছাড়া গ্রামের কেউ যেন কোনও পশু কুরবানি দেওয়ার দু:সাহস না-দেখায়।
প্রতিবাদ ও তদন্তের দাবি
মেহবুবা মুফতির পর ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাহ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি খবর পোস্ট করে লেখেন, “নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পুলওয়ামাতে একটি মসজিদের ভেতরে ঢুকেছে এ খবর খুবই বিচলিত করার মতো।”
“মসজিদে ঢোকাটাই খুব খারাপ, তার ওপর যেভাবে তারা সবাইকে দিয়ে জয় শ্রীরাম বলিয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন সেটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।”
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের কাছে তিনি গোটা ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তেরও দাবি জানান।
বর্তমানে বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত প্রবীণ কাশ্মীরি রাজনীতিবিদ গুলাম নবি আজাদও রবিবার এক টুইটে পুলওয়ামার ঘটনাটি প্রসঙ্গে লেখেন, “এই ধরনের জিনিস আমাদের সংস্কৃতিতে নেই, আইনও এর কোনও অনুমতি দেয় না।”
এটা এখনও অভিযোগের পর্যায়ে থাকলেও সত্যি সত্যি সে দিন কী ঘটেছিল তা খুঁজে বের করা দরকার এবং দোষীদের কঠোরতম সাজা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে মেহবুবা মুফতিও তার টুইটে সেনাবাহিনীর চিনার কোরের কমান্ডার লে: জেনারেল রাজীব ঘাইকে ট্যাগ করে এই ঘটনার তদন্ত দাবি করেছিলেন।
চিনার কোরের সদর দফতর হল শ্রীনগরে, কাশ্মীর ভ্যালিতে সেনা অভিযান চালানোর দায়িত্ব এই ইউনিটেরই। লে: জেনারেল রাজীব ঘাই মাত্র দিনসাতেক আগেই এই ইউনিটের দায়িত্ব নিয়েছেন।
সোশ্যাল মিডিয়াতেও তিনি এমনিতে বেশ সক্রিয়, কিন্তু মিস মুফতির টুইটের পর প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টা কেটে গেলেও লে: জেনারেল ঘাই তার বক্তব্যের কোনও জবাব দেননি।
এসডব্লিউএসএস১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ