দলের দুই প্রধান সেনাপতি নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ আক্ষরিক অর্থেই মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। র্যালি ও রোড-শো মিলিয়ে অন্তত দু’ডজন কর্মসূচি একাই করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। নজিরবিহীনভাবে ভোট প্রচারে এসে রাত্রিবাসও করেছিলেন দাক্ষিণাত্যের এই রাজ্যে।
মোদী-শাহ জুটি ছাড়াও কর্নাটকের ভোটযুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন বিজেপি শাসিত রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও হিমন্ত বিশ্বশর্মা। ডাবল ইঞ্জিন সরকারের উন্নয়ন, সুশাসনের পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত কর্নাটকের প্রতিশ্রুতি-বাদ যায়নি কিছুই।
ভোটযুদ্ধে হাতিয়ার করা হয়েছিল বজরংবলী থেকে টিপু সুলতানকেও। হিজাব বিতর্ক থেকে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে টানাপড়েন-ভোট প্রচারে এসেছিল তা-ও। কিন্তু ভোটের ফল বুঝিয়ে দিল, হিন্দুত্বের তাস থেকে দুর্নীতির কাদা ছোড়াছুড়ি, জনতার মন ছোঁয়নি কিছুই। বুথ ফেরত সমীক্ষার ফলাফলেও টের পাওয়া যায়নি-‘হাত’ ঝড়ে উড়ে যাবে ‘পদ্ম’। আগামী লোকসভা ভোটের আগের বছর কর্নাটক বিধানসভা ভোটের এই ফল প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে-এরপর কী?
যখন কোনো ভারতের কোনো রাজ্যে ভোটে বিজেপি জয়লাভ করে তখন তার পুরো কৃতিত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর যখন দল হাতে তখন এর দায় পড়ে স্থানীয় মানে রাজ্য নেতাদের ঘাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’ এ যাবৎ ওই বীজমন্ত্র জপ করেই ভোট বৈতরণী পার হয়ে এসেছে বিজেপি। কিন্তু হিমাচল প্রদেশের পরে ছ’মাসের মধ্যে কর্নাটকে হার! কংগ্রেসের বক্তব্য, দুই রাজ্যে ভোটের ফলেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে আদৌ অজেয় নন নরেন্দ্র মোদী। মানুষ ঘুরে দাঁড়ালে পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয় তাঁকেও।
কিন্তু গত কাল হারের পর থেকেই বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি রক্ষায় যাবতীয় দায় মূলত রাজ্য নেতৃত্বের দিকে ঠেলে দেওয়ার যে কৌশল নিয়েছে তার সমালোচনা করে সরব হয়েছে কংগ্রেস। তাদের বক্তব্য, রাত দিন এক করে পড়ে থেকে কর্নাটকে দলকে জেতাতে পারেননি মোদী। সেই হারের দায় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে।
গত কাল দলের বিপর্যয় স্পষ্ট হতেই প্রধানমন্ত্রীর উপরে যাতে হারের দায় না বর্তায় সে জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিজেপি নেতৃত্ব। ইতিমধ্যেই কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই জানিয়ে দিয়েছেন, ওই পরাজয়ের জন্য তিনি দায়ী। ঠিক কোন কারণগুলির জন্য দল হেরেছে তা পর্যালোচনা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অথচ প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ার কারণে মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন, ভোটের আগে হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদের তাস খেলা, বজরংবলী থেকে হিজাব বিতর্ক-মেরুকরণের জন্য এ হেন কোনও পন্থা নিতে পিছপা হননি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। কিন্তু ভোটের ফলেই স্পষ্ট মাটি কামড়ে নরেন্দ্র মোদী কর্নাটকে পড়ে থাকলেও, মানুষের মন জয় করতে পারেননি তিনি। উল্টে টানা এক মাস ধরে প্রধানমন্ত্রীর প্রচার চালানো সত্ত্বেও তাঁর দলকে ক্ষমতার কুর্সি থেকে টেনে নামিয়েছেন কর্নাটকের মানুষ।
সামনেই আরও চারটি বড় রাজ্যে নির্বাচন। তার পরে লোকসভা নির্বাচন। জিতলে প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব আর হারলে দোষ দলের-এই তত্ত্ব মেনেই প্রধানমন্ত্রীর অপরাজেয় ভাবমূর্তি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য পরিকল্পিত ভাবে তৎপর হয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মাও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এই হারের পিছনে প্রধানমন্ত্রীর কোনও ভূমিকা নেই।
তাঁর কথায়, ‘‘বিগত কয়েক মাস ধরে আসা সমীক্ষাগুলিই স্পষ্ট করে দিচ্ছিল রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে চলেছে। বাস্তবেও তাই হয়েছে।’’ কেন্দ্রীয় নেতা তথা বিধানসভায় পরাজিত বিজেপির সি টি রবির কথায়, ‘‘ওই হারের দায় দলের নয়। দায় আমাদের।’’ রবির কথা থেকেই স্পষ্ট হারের যাবতীয় দায় রাজ্য নেতৃত্ব নিতে প্রস্তুত।
প্রধানমন্ত্রীর দিকে যাতে আঙুল না ওঠে সে জন্য হারের জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে বাসবরাজ বোম্মাইকে। বছর দু’য়েক প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ার কারণে ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। এখন ভোটের ফলের পরে সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। দলের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী বদলের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
কিন্তু বি এস ইয়েদুরাপ্পার পরিবর্তে যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় সেই বাসবরাজ বোম্মাই উপযুক্ত প্রার্থী ছিলেন না বলেই এখন মনে করছে দলের একাংশ। তাদের দাবি, মূলত বোম্মাইয়ের প্রশাসন চালানোর প্রশ্নে অনভিজ্ঞতার কারণে দুর্নীতির লাগামছাড়া বাড়বাড়ন্ত হয়।
মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কড়া সাহস দেখাতে ব্যর্থ হন বোম্মাই। যা জনমানসে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সম্ভবত মানুষের সেই ক্ষোভের কারণেই চলতি নির্বাচনে বোম্মাই মন্ত্রিসভার ১২ জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ ছিলেন হিজাব নীতির অন্যতম কারিগর। হারের মুখ দেখতে হয়েছে তাঁকে।
প্রাথমিক ভাবে রাজ্য স্তরে বোম্মাই ও কেন্দ্রীয় স্তরে হারের জন্য প্রশ্নের মুখে বি এল সন্তোষের ভূমিকাও। হিমাচল প্রদেশে যখন বিজেপি হেরেছিল সে সময়ে ভূমিপুত্র জে পি নড্ডার উপরে যাবতীয় দোষ চাপিয়েছিল দল। এ ক্ষেত্রে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ কর্নাটকের ভূমিপুত্র হওয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে তাঁর ভূমিকা।
বিজেপি যখন মোদীকে আড়াল করতে ব্যস্ত তখন প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছে কংগ্রেস। ছত্তীসগঢ়ের কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের কথায়, ‘‘গোটা নির্বাচনটি লড়া হল মোদীকে সামনে রেখে। এখন ভোটের পরে দায় নিচ্ছেন বাসবরাজ। এ কেমন কথা! ওই দায় তো নরেন্দ্র মোদীর নেওয়া উচিত।’’
এসডব্লিউএসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ