আমদানিতে জোয়ারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি চূড়ায় উঠেছে। গত ৭ মাসে এক লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। আমদানিতে অর্থ ব্যয়ের চেয়ে রপ্তানি ও প্রাবাসী আয় কম হচ্ছে। যার কারণে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৩৮ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৭ টাকা ধরে) এর পরিমাণ এক লাখ ৪৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৪ হাজার ৪০৩ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৭ মাসে ৪ হাজার ৬৬৭ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
এছাড়া আমদানির বিপরীতে এ সময় রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৬৪ কোটি ডলারের পণ্য। যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি। গত বছর একই সময়ে ২ হাজার ৭৮৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।
এদিকে ডিসেম্বর শেষে দেশে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ২৩০ কোটি ডলার। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১০৮ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি শেষে সেবা খাতে দেশ আয় করেছে ৫২৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় ৭৫০ কোটি ডলার। এতে সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২২৪ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি ডলার।
এছাড়া সামগ্রিক লেনদেনেও বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। জানুয়ারি শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) অংক দাঁড়িয়েছে ৭৩৮ কোটি ডলারে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে (ঋণাত্মক) ২০৫ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিল।
তবে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই বেড়েছে। আলোচ্য এই সাত মাসে এফডিআই এসেছে ৩০৬ কোটি ডলার। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ২৭৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যালান্স অফ পেমেন্ট সীমা ছাড়িয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিন্তু আমদানি বাড়ায় তারপরও চাহিদা মিটছে না।’
তিনি বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়। যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এ ছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
‘সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। বলা হয়, আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ব আমরা।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘দাম বাড়ায় সরকারের জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে গ্যাসে ভর্তুকি বেড়েছে, সারে বেড়েছে। বিদ্যুতে বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ পড়বে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘আমদানির লাগাম টানতে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ২৫ শতাংশ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আমি মনে করি, এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।’
এসডব্লিউএসএস/২২১০
আপনার মতামত জানানঃ