ইতিহাসের পাতায় মেসোপটেমীয় সভ্যতা অমলিন হয়ে আছে তার প্রাচীনত্বের জন্য। প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতাকে বলা যেতে পারে মেসোপটেমীয় সভ্যতার স্রষ্টা। বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর স্থানেই গোড়াপত্তন ঘটে সুমেরীয় সভ্যতার।
তবে, সুমেরীয়দের আদি অবস্থান সুমের ছিল না। যেহেতু মেসোপটেমিয়ার উর্বর জমি ছিল কৃষিকাজের জন্য যথোপযুক্ত, তাই সুমেরীয়দের একটি দল মেসোপটেমিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এলামের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে মেসোপটেমিয়ার দিকে অগ্রসর হয়েছিল।
প্রাচীন এই সুমেরীয়রাই গড়ে তুলেছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর এরিদু। মেসোপটেমিয়ার ধ্বংসস্তূপে যে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন ছিল এরিদু শহরের ধ্বংসাবশেষ। খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৫৪০০ অব্দের দিকে এরিদু শহরের উত্থান বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত।
উর শহরের ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এরিদু ছিল মেসোপটেমিয়ার সর্বদক্ষিণের এক প্রাচীন শহর, যা গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধর্মীয় মন্দিরকে ঘিরে। একটি মাটির ইটের পিঠে আরেকটি ইট চাপিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এর দালানসমূহ। চারপাশের বিভিন্ন গ্রামের মাঝে ভিতরে সুরক্ষিত মন্দির।
এটিই ছিল এরিদু শহরের মূল ভিত্তি-কাঠামো। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের দিকে এরিদু ১০০ একরের জায়গা দিয়ে বেষ্টিত ছিল। এর মধ্যে ৫০ একর ছিল আবাসিক স্থল আর ৩০ একর বরাদ্দ ছিল অ্যাক্রোপলিসের (নগর-কেন্দ্রের উচ্চভূমি) জন্য।
প্রত্নতত্ত্ববিদ পিউটর স্টেইনকেলারের মতে, শুরুতে প্রাচীন এরিদুতে দেবকুলের প্রধান হিসেবে আরাধনা করা হতো ‘নিনহুরসাগ’কে, যিনি ওই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীর দেবী হিসেবে।
অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাসবিদ গয়েনডলিন লেইকের মতানুযায়ী, বহু নদীর পানি গিয়ে যেমন একসাথে সমুদ্রে মিশে যায়, তেমনি এরিদু ছিল তিনটি পৃথক সংস্কৃতি ও জাতির মিলনস্থল। উত্তরের সামারা সংস্কৃতি থেকে আগত মানুষেরা জড়িত ছিল কৃষিব্যবস্থার সাথে। তারা সেচ ব্যবস্থার পাশাপাশি খাল নির্মাণের সাথেও জড়িত ছিল। তাদের ঘরগুলো ছিল কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরি। আবার, আরব উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায় আরব উপকূল বরাবর বাসস্থান গড়ে তুলেছিল। এদের একাংশকে ধরা হয় আদি সুমেরীয় হিসেবে। তারা বাস করত কুঁড়েঘরে।
এরিদু শহর নির্মাণে অবদান রাখা তৃতীয় সংস্কৃতিটি হলো মরুতে বসবাসরত সেমিটিক-ভাষাভাষী যাযাবর সম্প্রদায়, যারা ভেড়া ও ছাগলের পালের উপর জীবিকা নির্বাহ করত। শহর উত্থানের সময়কালে এই তিন সংস্কৃতির মানুষই শহরে এসে জড়ো হয়েছিল, যা এরিদুর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির এক অনুপম মিশ্রণকে প্রদর্শন করে। এরিদু সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার মন্দির জিগুরাতের জন্য।
জিগুরাত মানে হচ্ছে মন্দিরের ভিত্তি। এর দ্বারা উচ্চ স্থানে অবস্থিত মন্দিরে পৌঁছানো যায়। এরিদুতে সর্বপ্রথম জিগুরাত নির্মাণ করা হয় উবাইদ যুগে, খ্রি.পূ. ৫৫৭০ অব্দে। এই জিগুরাতের কেন্দ্রে থাকত ছোট এক কক্ষ, বিশেষজ্ঞরা যার নাম দিয়েছেন ‘কাল্ট নিচে’। দীর্ঘ একটা সময় বিরতির পর এর চেয়েও বৃহৎ মন্দির নির্মিত হয়েছে।
প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায় এরিদু বিশেষ গুরুত্ব বহন করত। অ্যাসিরিয়ার দরবার থেকে এরিদুতে এসে চিকিৎসকেরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যেত, যাতে তারা উপসর্গ দেখেই রোগের কারণ, প্রতিকার, ও প্রতিরোধের উপায় বাতলে দিতে পারেন। নিরাময়ে তারা ঔষধের পাশাপাশি জাদুবিদ্যায়ও বিশ্বাস রাখতেন। শুরুর দিকে এখানকার বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম ছিল মৎস্য শিকার।
ধ্বংসাবশেষে মাছ ধরার জাল, মাছের কাটা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এছাড়াও, মেসোপটেমিয়ায় সর্বপ্রথম বৃহৎ নৌকা তৈরির সন্ধান পাওয়া গেছে এই এরিদুতেই। ধারণা করা হয়, এই শহর ছিল মৃৎশিল্প উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল।
এরিদু বেশ ভালোভাবে বিস্তৃতি লাভ করে উবাইদ যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০০ অব্দ – খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭০০ অব্দ)। তখন এর আয়তন ছিল ২০-২৫ একরের কাছাকাছি, জনসংখ্যাও ছিল প্রায় ৪ হাজার ছুঁই ছুঁই। উবাইদ যুগের পর, এরিদুতে সমস্ত ব্যবহারিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রাক-রাজবংশীয় সময়কালে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৯০০ অব্দ – খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৫০ অব্দ) শহরটি পুনরায় সচল করা।
ওই রাজবংশের একটি প্রাসাদও নির্মাণ করেছিল এরিদুতে। ইতিহাসবিদ রুথ হোয়াইটহাউজ এই শহরকে ‘প্রধান প্রারম্ভিক রাজবংশীয় শহর’ বলেও অভিহিত করেছেন। খ্রি.পূ. ২০৫০ অব্দের পর শহরটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে পরিত্যক্ত থাকতে থাকতে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী বালির টিলাগুলো দখলের পাশাপাশি, ওখানের জল হয়ে উঠেছিল লবণাক্ত। লবণাক্ত জলের ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অনুষঙ্গ কৃষিকাজে দারুণ ব্যাঘাত ঘটছিল।
বিভিন্ন সমস্যার মুখে পতিত হওয়ায় এরিদুর বাসিন্দারা সরে যায় অন্যত্র, গড়ে ওঠে ব্যবিলন শহর। ব্যবিলন শহরে গড়ে ওঠার পর পরই সমাপ্তি ঘটে সুমেরীয় সভ্যতার, প্রাচীন পৃথিবী পরিচিত হয় তুলনামূলক আধুনিক এবং ইতিহাস বিখ্যাত এক সভ্যতার সাথে।
এসডব্লিউএসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ