২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন পাসের পর আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছর কাজ করেছিলেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বিএফআইইউর উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হুন্ডিসহ মানি লন্ডারিংয়ের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
সেখানে দেশে সাসপেক্টেড ট্রানজেকশন রিপোর্টের (এসটিআর) বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে মাহফুজুর রহমান বলেন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব এসটিআর রিপোর্ট পাঠানো হয়, বিদেশে সেগুলো বিশেষ সফটওয়্যারে যাচাই–বাছাই করা হয়। ওই রকম সফটওয়্যার আমাদের দেশে নেই। ফলে বিএফআইইউর ৬০–৭০ জন কর্মকর্তার পক্ষে এত এসটিআর ঘেঁটে কোনটি সত্য, কোনটি ভুয়া, সেটি বের করা কঠিন।
কারণ, দেশে ব্যাংক থেকে খুব মানসম্পন্ন প্রতিবেদন আসে না। তারা তদন্ত করে প্রাথমিক তথ্য দেয় না। যেনতেন প্রতিবেদন যাচাই–বাছাই করতে শক্তি নষ্ট হচ্ছে। আবার বিদেশের অনেক জায়গা থেকে তথ্য পাওয়া যায় না। যেমন সুইস ব্যাংক তথ্য দেয় না। সুইস ব্যাংককে চাপ দিলে তারা বলে, কোন দেশের নাগরিকের কত টাকা আছে, সেটি আমরা বলব। কিন্তু কার আছে, সেটি বলব না।
বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিং তো খুব সহজ। যেমন একটা সফটওয়্যারের দাম ১০ হাজার ডলার। কিন্তু দেখিয়ে দেওয়া হলো ২ কোটি ডলার। এটি ধরার কোনো বুদ্ধি নেই। এমন কিছু পণ্য রয়েছে, যার মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। একটা শার্ট রপ্তানি করছে ৫ ডলার। কিন্তু প্রকৃত দাম ১০ ডলার। তাহলে ৫ ডলার তো বিদেশে রয়ে গেল। রপ্তানিকারক তখন ওই টাকা বিদেশের কোনো হিসাবে জমা করান।
যারা নতুন শিল্পকারখানা করেন, তারা দুই লাখ টাকার একটা মেশিন ঋণপত্রে দেখাচ্ছেন ৪ লাখ টাকা। আমাদের দেশ থেকে ৪ লাখ টাকা চলে গেল। কিন্তু ওই দেশ থেকে আসছে ২ লাখ টাকার জিনিস। এভাবে ২ লাখ টাকা পাচার হয়ে গেল। আবার হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। একজন সিঙ্গাপুরে টাকা দিল। তার বিপরীতে দেশে পরিশোধ করা হলো। এভাবে ডলার হয়ে টাকা ওই দেশে চলে গেল। এভাবে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
মাহফুজুর রহমান জানান, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে কেবল ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশে টাকা পাঠানো যায়। আবার কেউ যদি পড়াশোনা করতে চায়, তাহলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি লাগবে। ভর্তির কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংকে হিসাব খুলে যেতে হয়। আবার কেউ বিদেশে চিকিৎসা করালে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে ওই হাসপাতালের পাওনা অর্থ পাঠানো যায়। আবার কেউ বিদেশে বেড়াতে গেলে ১২ হাজার মার্কিন ডলার সঙ্গে নিতে পারেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচারের সুযোগ নেই।
কানাডা, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের বাড়ি কেনা প্রসঙ্গে মাহফুজুর রহমান বলেন, মালয়েশিয়ায় একটা এলাকা আছে, সব বাড়ি বাংলাদেশিদের। মালয়েশিয়ায় একবার কথা প্রসঙ্গে এক ট্যাক্সিক্যাবচালকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাকে বলেছিলেন, এসব বাড়ির মালিক সব বাংলাদেশি। সরকারি কর্মকর্তারা যে ঘুষ খায়, সেটি তো মানি লন্ডারিংয়ের চেয়ে বড় অপরাধ। সেটা সবার আগে ধরতে হবে। কিন্তু ধরা পড়ে কম। শাস্তিও হয় না।
উল্টো দেখা যায়, যে কর্মকর্তা ঘুষ খাচ্ছেন, তাকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে অবৈধভাবে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলে তাদের মনে ধরা পড়ার ভয় ঢোকে। তখন ওই কর্মকর্তা এই অবৈধ টাকা লুকানোর চেষ্টা করেন। তখন তার মাথায় বিদেশে অর্থপাচারে চিন্তা আসে। দেশ থেকে অর্থ পাচার করা কঠিন কিছু না।
হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক করে নিলে অর্থ অটোমেটিক বিদেশে চলে যায়। এ দেশে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিশাল নেটওয়ার্ক। কোনো হুন্ডি ব্যবসায়ীকে দেশে আজ অর্থ দিলে সঙ্গে সঙ্গে যে দেশে পেতে চান, সেই দেশে অর্থ পেয়ে যাবেন।
মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা মালয়েশিয়ায় বহুবার চিঠি দিয়েছি, জানতে চেয়েছি সেকেন্ড হোম প্রকল্পে কত বাংলাদেশি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু মালয়েশিয়া কোনো তথ্য দেয়নি। তারা বলেছে, এটি তাদের একটা কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন দেশের মানুষ আসে। তবে সুনির্দিষ্ট কারও তথ্য চাইলে জানানো হবে। একই কথা অন্যান্য দেশও বলে।
বিএফআইইউ কিংবা অন্য কেউ বিদেশের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে না। এ কাজটি করতে পারে আমাদের দেশের দূতাবাস। দূতাবাস সহায়তা না করলে বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য বা অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
বিএফআইইউর ঘাটতি আছে বলে তিনি জানান, বিএফআইইউর জনবল বাড়াতে হবে। তাদের আরও প্রশিক্ষণ লাগবে। আমি মনে করি, বিএফআইইউর প্রশাসনিক কাঠামো আন্তর্জাতিক মানের নয়। পৃথিবীর অনেক দেশে আমি দেখেছি, ব্যাংক–বিমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো সন্দেহজনক লেনদেনের প্রতিবেদনের মূল কথায় প্রাসঙ্গিক তথ্য থাকে, সেটি দেখে অপরাধী বের করা যায়।
কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার প্রতিবেদন আসে, সব যাচাই করতে হয়। সব যাচাই করে আসল অপরাধী বের করা কঠিন। আর ব্যাংকগুলোকেও এসব বিষয়ে ওইভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তাদের ভাসা ভাসা প্রশিক্ষণ হয়েছে বলি আমি মনে করি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যাংকের গ্রাহকের কেওয়াইসির তথ্য পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। অনেক ব্যাংক রিপোর্ট করে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে বড় লেনদেনের হিসাবধারীর তথ্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে চাইতে পারে। অনেক অপরাধী বেনামে ব্যাংকে টাকা রাখেন। সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান না দিলে বড় অঙ্কের জরিমানা করতে হবে। বিদেশে এমন নিয়ম আছে।
মানি লন্ডারিং রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক ক্ষমতা। আর্থিক ব্যাপারে সরকার কোনো কিছু করতে চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্তি জানানোর সুযোগ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারে। আমরা কখনো এমন কিছু করতে শুনেছি? করেনি।
অন্যান্য দেশে গভর্নর অনেক ক্ষমতাবান। আর্থিক অপরাধ সর্বোচ্চ ধরনের অপরাধ। এক পয়সা জালিয়াতি আর এক কোটি টাকা জালিয়াতি একই কথা। এক পয়সা জালিয়াতি করলেও তার শক্ত বিচার করতে হবে।
এসডব্লিউএসএস/২১২৫
আপনার মতামত জানানঃ