বাংলাদেশের পুলিশ বলছে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত নিয়ে গুজব রটাতে দেশ ও বিদেশ থেকে কাজ করছে জামায়াত শিবির। এরইমধ্যে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অন্তত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে।
আজ সোমবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃত সবাই জামায়ত শিবিরের সমর্থক এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে এসব গুজবের পেছনে কারা কারা আছে এবং কারা বিদেশ থেকে এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমরা দেখেছি এটা একটা জামায়াত-শিবিরের গ্রুপ যারা এই গুজবটি রটাচ্ছেন, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাদের সাথে আরো কারা কাজ করছে সে বিষয়েও তারা তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত নিয়ে গুজবের এই তথ্য এমন সময়ে আসলো যখন বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে নানা অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে আসছিল তারা, যা নজরে আসলে এ বিষয়ে তদন্ত করা হয়।
পুলিশের এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, পুলিশের তদন্তের বিষয়ে তারা কিছু জানে না। ব্যাংকটির মুখপাত্র মেজবাহ উল হক বলেছেন, তারা তাদের তদন্তে যা পেয়েছে তাই হয়তো তুলে ধরেছে। এ বিষয়ে আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করা হয়নি।
ইসলামী ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপ
বাংলাদেশে সম্প্রতি কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া সম্পর্কিত খবর প্রকাশিত হয় স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে।
এসব খবরে বলা হয়, বেশ কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। পুলিশ বলছে যে, এ বিষয়টি নিয়েও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক এক সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মীর কাশেম আলীসহ অন্যান্য জামায়াত নেতাদের ছিল। পুলিশ বলছে, তাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোকে অন্য একটি পরিচালনা পর্ষদের হাতে দেয়ার পর থেকেই এ নিয়ে অপপ্রচার শুরু হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের হাতে কয়েকটি ব্যাংক পরিচালনার ভার থাকায় তাদেরকে টার্গেট করে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ জানায়, “(তারা) বলছে ব্যাংক লুট হয়ে গেছে, ব্যাংকগুলো ডাকাত, ওদের ধরো, এভাবে দেখবেন ঢাকা শহরে, বাংলাদেশের সব জায়গায় পোস্টারিং শুরু করেছে। আমার তদন্ত করে দেখলাম, এটা টোটালি একটা গুজব।”
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। খবরে বলা হয়েছে তারল্য সংকট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তহবিল থেকে বছরের শেষ কর্মদিবসে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংক।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিপত্রের কথা উল্লেখ করে পুলিশ বলছে যে, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে। এদিকে পুলিশ বলছে, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা, দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করা এবং সাধারণ মানুষ যেন তাদের প্রোপাগাণ্ডায় বিশ্বাস করে টাকা তুলে নিলে অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করা এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলা তাদের (গুজবকারীদের) একটা লক্ষ্য ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ রয়েছে। ব্যাংকটির মুখপাত্র মেজবাহ উল হক বলেন, এলসিও এখন হচ্ছে, রেমিটেন্স বাড়ছে, রপ্তানি আয় বাড়ছে। তবে এখনো খরচের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
“আমরা সতর্কতা অবলম্বন করছি যাতে, যদি আমাদের কখনো অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হয়, তখন যাতে সমস্যা না হয়।”
কেন গুজব ছড়ায়?
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাহ উল হক বলেন, ব্যাংকের মূল বিষয় হলো জনগণের বিশ্বাস। আমানতকারীরা তাদের আমানত বিশ্বাসের ভিত্তিতেই ব্যাংকে রাখে।
কিন্তু যখন একটি ব্যাংকের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়, তখন আমানতকারীরা তাদের অর্থ তুলে নিলে তারল্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা থাকে ওই ব্যাংকের, যে কারণে ব্যাংক সম্পর্কিত তথ্য বেশ স্পর্শকাতর বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকের ঋণ বিতরণে অনিয়মের একাধিক অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেয়ার হিড়িক পড়ে যায়।
গত অক্টোবর মাসের শেষে ইসলামী ব্যাংকে আমানত ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা এখন এসে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায়। ফলে ইসলামি ব্যাংকে বড় ধরনের তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। কয়েক দফায় বন্ড দিয়ে টাকা ধার নিয়েছে এসব ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গুজব সব সময় ছড়ায় না। এসব গুজব কিছু সময় থাকে যখন গুজব ছড়ানোর সুযোগ পায়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সময় হচ্ছে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগের সময়। তারা বলছেন এবছর বর্তমান সরকারের শেষ বছর হওয়ায় এধরনের গুজব ছড়ানো হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে তার মধ্যে সত্যতা রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে। বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট নিয়ে আলোচনা চলছে, ব্যাংকে ঋণ খেলাপি নিয়ে কথা হচ্ছে। তাই গুজব ছড়ানোর মতো উপাদান রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কিছুদিন ধরে বলা হচ্ছে ব্যাংকে টাকা নাই, তারল্য সংকট চলছে। তিনি মনে করেন, তারল্য সংকট অতীতেও ছিল। এটা ব্যাংকের একটা নিয়মিত চিত্র।
“ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ অর্থ বাহিরে যায় এবং সেই অর্থ ফেরত আসে না – তার উপর নির্ভর করে ব্যাংকের তারল্য সংকট হবে কি না।”
তিনি বলেন খেলাপি ঋণের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গেলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বাড়বে। তবে বাংলাদেশ সেই পর্যায়ে গেছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভাল দেখানোর জন্য অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংক কম ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণগুলোকে নিয়মিত করানোর চেষ্টা করে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে বা প্রকৃতপক্ষে এটি আসলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাকে ভাল করে না।
তিনি বলেন কোন ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভাল না হলে, গ্রাহকরাও সেই ব্যাংকে আমানত রাখার বিষয়ে আগ্রহী হয় না। আর এ কারণেই ব্যাংকের অবস্থা ভাল দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে।
এসডব্লিউএসএস/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ