প্রতি অর্থবছরে দেশের রপ্তানি খাতের অর্থপ্রাপ্তির পরিসংখ্যান নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্সপোর্ট রিসিপ্টস অব গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ২০২১-২২ শীর্ষক গত সপ্তাহে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যমূল্য ও এর বিপরীতে দেশে আসা রপ্তানি আয়ের বিশাল পার্থক্য দেখা গেছে।
দেশের রপ্তানি খাতের পণ্যভাণ্ডার তুলনামূলক কম। বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হয়, এমন খাত হাতে গোনা পাঁচটি—পোশাক, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষিপণ্য। প্রতি বছরই দেখা যায়, এ খাতগুলোর রফতানীকৃত পণ্যমূল্যের সঙ্গে এর বিপরীতে দেশে আসা অর্থের মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে। বিশেষ করে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রধান খাতগুলোর প্রায় সবক’টিতেই রফতানীকৃত পণ্যের মূল্য ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান দেখা গিয়েছে।
ব্যবধান কতটা?
সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে হোম টেক্সটাইল খাতে। খাতটিতে গত অর্থবছরে রফতানীকৃত পণ্যমূল্যের প্রায় ৫৮ শতাংশ অর্থ দেশে আসেনি। পোশাক খাতে রপ্তানি মূল্য ও অর্থপ্রাপ্তির ব্যবধান ২৩ শতাংশের বেশি। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের পার্থক্য ৪১ শতাংশ। পাট ও পাটজাত পণ্যে পার্থক্য প্রায় ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে রফতানীকৃত হোম টেক্সটাইল পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ১৬২ কোটি ডলার। বিপরীতে পাওয়া অর্থের পরিমাণ ৬৮ কোটি ডলার। এ হিসেবে রপ্তানি ও প্রাপ্ত অর্থের পার্থক্য ৫৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
দেশের মোট রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের অবদান ৮২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে পোশাক রপ্তানিবাবদ অর্থ এসেছে ৩ হাজার ২৬৮ কোটি ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছরে তৈরি পোশাকের রফতানীকৃত মূল্যের ২৩ দশমিক ২৯ শতাংশ দেশে আসেনি।
গত অর্থবছরে রপ্তানির অর্থমূল্য বিবেচনায় তৃতীয় বৃহৎ খাত ছিল চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। পণ্যটি রপ্তানির অর্থমূল্য ছিল ১২৪ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ ৪১ শতাংশ কম। এ হিসেবে গত অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ৭৩ কোটি ডলার।
সোনালি আঁশখ্যাত পাট ও পাটজাত পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। একসময় একমাত্র প্রধান রপ্তানি পণ্যটির অংশ এখন মোট রপ্তানিতে অনেক কম। গত অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির অর্থমূল্য ছিল ১১২ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিবাবদ প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ১০১ কোটি ডলার। এ হিসেবে রপ্তানি ও প্রাপ্ত অর্থের পার্থক্য প্রায় ১০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
রপ্তানি মূল্য ও এর বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির পরিসংখ্যানগত পার্থক্যের পেছনে অসাধু বাণিজ্যিক চর্চা দায়ী বলে সন্দেহ করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের বক্তব্য হলো বিশ্বের অন্য অনেক স্থানের মতো বাংলাদেশেও অর্থ পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। পণ্য রপ্তানি করে অর্থ দেশে না আনার অভিযোগ রয়েছে অনেক। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। এর পরও নানা ফাঁকফোকর গলে এমন কাজ হয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এজন্য ব্যাংকের নজরদারি ব্যবস্থা আরো শক্ত হওয়া প্রয়োজন। আবার কভিডকালের নানা দুর্বিপাকেও রফতানীকৃত পণ্যের মূল্য ও প্রাপ্ত অর্থের পার্থক্য বেড়েছে। এছাড়া পরিসংখ্যানেও গরমিল থাকতে পারে। তবে যত কারণই থাকুক না কেন, এত বড় ব্যবধান খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
পোশাকপণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এ বিষয়ে বলেন, ‘পার্থক্য এত বেশি হওয়ার কথা নয়। আমাদের এখন অনেক ডেফার্ড পেমেন্ট (বিলম্বিত মূল্য পরিশোধ) মেনে নিতে হয়। পণ্য জাহাজীকরণের ৩০ থেকে ৯০ দিন পরও অর্থ পাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেক ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে এমন হয়। পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থ গ্রহণের সময়ে পার্থক্য হতেই পারে। ১০০টি ঋণপত্র খোলা হলে ৯৫ শতাংশেই দেখা যায় শতভাগ অর্থ পরিশোধ হয়েছে। ব্যাংক চার্জ কাটার কারণে অর্থপ্রাপ্তি কম হতে পারে। ডিসকাউন্টের ক্ষেত্রে আমরা ৫ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারি। এর বেশি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। এটা নিশ্চিত যে অর্থ পরিশোধ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এত কম অর্থ এলে আমরা কেউ বাঁচতাম না। কাজেই এটা অসম্ভব ব্যাপার।’
দেশের হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সবই বস্ত্র খাতের সুতা ও কাপড় উৎপাদনকারী মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্য। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘হোম টেক্সটাইলে রপ্তানি ও অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য এত বেশি হয় কী করে? তাহলে বাকি টাকা গেল কোথায়? আমার মনে হয় কোনো ভুল আছে। রপ্তানির পরিসংখ্যানটা এনবিআর ও ইপিবি থেকে পাওয়া যায়। অর্থপ্রাপ্তির তথ্যটি বাংলাদেশ ব্যাংকের। দুই পরিসংখ্যানে এত পার্থক্য থাকার কথা নয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে বিষয়টি মানি লন্ডারিংয়ে পড়ে যাওয়ার কথা। ডিসকাউন্ট ৫ থেকে ১০ শতাংশ হতে পারে, এর বেশি নয়। এছাড়া অনেক সময় বন্দরে পণ্য পড়ে থাকে, ছাড় করে না। অনেক সময় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেলে পণ্য নেয় না। হোম টেক্সটাইলের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এত বড় পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। আমার কাছে পার্থক্যটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। রপ্তানি হয়েছে, কিন্তু কোনো অর্থ পরিশোধ হয়নি। অনেক সময় রপ্তানির অর্থ দাবি মীমাংসায় অনেক সময় লেগে যায়। দেখা যায়, জাহাজীকরণের ছয় মাস পরে অর্থ পরিশোধ হয়।’
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) ভাইস চেয়ারম্যান মৃধা মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘আমাদের পাট খাতে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। অর্থ পরিশোধ হয় না, এমন ঘটনা আমাদের খাতে খুবই বিরল। অর্থ পরিশোধ না হওয়া বা কম আসার ঘটনা খুবই কম। পাট ও পাটজাত পণ্যের ক্রেতাও সীমিত, এ খাতের ক্রেতাও হাজার হাজার নয়, যার কারণে অর্থ পরিশোধ না হওয়ার ঘটনা খুবই কম। অনেক সময় আমরা পণ্য জাহাজীকরণের পর ক্রেতা অর্থ পরিশোধ করে চালান ছাড় করেন। ক্রেতার পক্ষ থেকে অনেক সময় অর্থ পরিশোধ ডেফার্ড হয়। দুই মাস পরে অর্থ পরিশোধ হয়। এ খাতে ডিসকাউন্ট খুব কম।’
এক্ষেত্রে অর্থ পাচারসহ অনৈতিক ব্যবসায়িক চর্চা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে স্বীকার করে নিলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি হওয়া পণ্য এবং সেগুলোর বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের পার্থক্য হওয়ার কারণ হলো অনেক সময়েই দেখা যায়, জাহাজীকরণের পরেও ক্রেতাপক্ষ ডিসকাউন্ট চেয়েছে। বিধান আছে ১০ শতাংশের বেশি ডিসকাউন্ট করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, রপ্তানিকারকদের দরকষাকষির সক্ষমতায় ঘাটতির কারণে ডিসকাউন্টের হার অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া সঠিক সময়ে পণ্য না দেয়ার কারণে বা মান যথাযথ না হওয়ার কারণেও ক্রেতারা ডিসকাউন্ট চেয়ে বসে। আবার নানা সময় দেখা গিয়েছে, ক্রেতা কোনো না কোনো কারণে পণ্যের চালান গ্রহণই করেনি। অর্থাৎ ডেলিভারি না নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, রপ্তানি হওয়া পণ্যের বিপরীতে কোনো অর্থই আসেনি।
ইপিবি সূত্র বলছে, রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করা হয় শুল্ক কর্তৃপক্ষ পর্যায়ের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে। রপ্তানি ও রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে গরমিল থেকে যাওয়ার বেশকিছু কারণ আছে। এর একটি হলো সময়সীমা। ইপিবির পরিসংখ্যানগুলো বন্দরে পণ্যের চালান জাহাজীকরণভিত্তিক। আর বাংলাদেশ ব্যাংক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে পাওয়া অর্থের হিসাবের ভিত্তিতে। রপ্তানি হওয়া পণ্য আমদানিকারকের হাতে পৌঁছার পর পরিশোধিত অর্থ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রত্যাবাসন হলে সেটিকেই এক্সপোর্ট রিসিপ্ট হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়। এক্ষেত্রে পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থপ্রাপ্তির সময়ের ব্যবধানের কারণেও দেশে আসা অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক শর্তও রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করে দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, রপ্তানির বিল অব এন্ট্রিতে ঘোষিত মোট মূল্যের একটি অংশ চালানের বীমা বাবদ বা পরিবহন খরচ বাবদ কেটে রাখার কথা রয়েছে। এ কারণে যখন অর্থ প্রত্যাবাসন হয় তা একটি নির্ধারিত অংশ বাদ দিয়ে আসে। সব মিলিয়েই রপ্তানি ও প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। এ পার্থক্য কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ