বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন খুবই চমৎকার বলে মনে করা হয়। ১৯৭১ পরবর্তী ফারাক্কা বাঁধ, সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতীয় সাহায্যসহ বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বেশ উষ্ণ বলেই প্রচার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ততটা সুখকর বলে মনে হয় না। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা এই দাবির যৌক্তিকতাকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এই মনে হওয়াকে বাস্তবে পরিণত করে ফেনীর পরশুরামের বাঁশপদুয়া উত্তরপাড়া সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে বাংলাদেশি যুবকের গলিত মরদেহ পেয়েছেন স্থানীয়রা। সেটি উদ্ধারে পুলিশ ও বিজিবি কাজ করছে বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন।
মৃত মো. মেজবাহর বাঁশপদুয়া উত্তরপাড়ার মফিজুর রহমানের ছেলে। তার মরদেহ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় লোকজন দেখতে পান।
মেজবাহরের স্ত্রী মরিয়ম আক্তার জানান, গত সোমবার বিকেলে সীমান্ত এলাকায় যান মেজবাহর। সেখানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিএসএফের সদস্যরা তাকে আটক করে। সেখানে তাকে মারধর করা হয় বলে স্থানীয় লোকজন দেখতে পান। কিছুক্ষণ পর গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়।
খবর পেয়ে মরিয়ম ও তার পরিচিতরা সেখানে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে মেজবাহরকে পাননি। বুধবার সকালে গিয়ে মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
পরশুরাম পৌরসভার কাউন্সিলর মো. সুমন বলেন, ‘মেজবাহরের খোঁজে সকালে এলাকার লোকজনকে সীমান্তে পাঠালে জঙ্গলের ভেতর লাশ পড়ে থাকতে দেখতে পায়। তার মুখের অংশ থেঁতলে গেছে। লাশ এখনও সীমান্তে আছে। আমরা নিশ্চিত এই লাশটি মেজবাহরের।’
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা শমসাদ বেগমও নিশ্চিত করেছেন, মরদেহটি মেজবাহরের।
ফেনী জায়লস্করের ৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এ কে এম আরিফুল ইসলাম জানান, সীমান্তে একটি লাশ পড়ে আছে শুনেছেন। এ বিষয়ে আরও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
মূলত বন্ধু রাষ্ট্রের গালগল্পের ভীড়ে সীমান্ত হত্যা যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষদের জন্যে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনাতেও কোনও সমাধান আসেনি, যার ফলে সীমান্ত হত্যা চলছেই।
নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
এসডব্লিউএসএস/১৯৩৭
আপনার মতামত জানানঃ