আজ থেকে ৩৪ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে হেঁটে বেড়াতো আমাদের অ্যামনিওটদের (amniotes–মূলত পাখি, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ীরা) পূর্বপুরুষ ক্যাসিনেরিয়া(casineria)। সেই প্রাচীন পৃথিবীতে তখন বিরাজ করছে অদ্ভুত এক যুগ! আকাশে উড়ে বেড়ায় দৈত্যাকার সব পোকামাকড়। কার্বনিফেরাস যুগ। এই বিশাল পৃথিবীর কীটপতঙ্গের রাজ্যে ছোট্ট ক্যাসিনেরিয়া তখন নিজেও জানতো না, তার উত্তরসূরীরাও একদিন এই পৃথিবীতে রাজত্ব করবে৷ আকাশ, স্থল, জল—সবখানে ছড়িয়ে যাবে তার সন্তানেরা। ক্যাসিনেরিয়ারা ডিম দেয়ার মাধ্যমে প্রজনন ঘটাতো। যেটা এখনও তাদের উত্তরসুরীদের মধ্যে রয়ে গেছে পুরোপুরিভাবেই, আবার কারোর মধ্যে ঘটেছে একটুখানি পরিবর্তন।
বিবর্তনের ধারায় অ্যামনিওটদের পূর্বপুরুষের ভিটেলোজেনিন জিন তার পরবর্তী বংশপরম্পরায় প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে স্থানান্তর। উভচর, পাখি, সরীসৃপ এবং প্লাটিপাস অবধি এ জিন বহাল তবিয়তে টিকে গেছে বিধায় তারা শক্ত খোলসাবৃত, কুসুম থলিতে আবদ্ধ কুসুম সমৃদ্ধ ডিম তৈরি করে প্রজননের সময়। প্লাটিপাস ছাড়া বাকি সকল স্তন্যপায়ীর দেহে এ জিনের অস্তিত্ব থাকলেও বিবর্তনের লম্বা যাত্রাপথে তারা পূর্ণরূপে থাকতে পারেনি।
পাখি এবং আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ মিল হচ্ছে, আমরা উভয়ই এসেছি ডিম থেকে। খুলে বলি। পাখির ভ্রূণের পরিস্ফুটনের সময় ভ্রূণে সৃষ্টি হয় Yolk sac। এটাকে বাংলা করলে আমরা পাই “কুসুম থলি”। এর সংজ্ঞাটা দেখে নেয়া যাক—কুসুম থলি হচ্ছে, ভ্রূণের মধ্যান্ত্রের সঙ্গে যুক্ত এবং এন্ডোডার্ম ও মেসোডার্ম গঠিত অপেক্ষাকৃত ছোট থলি আকৃতির তরলে পূর্ণ ঝিল্লি। পাখি এবং সরিসৃপদের কুসুম (yolk) এই কুসুম থলি দ্বারা আবৃত থাকে। একটা শিশু পাখি বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় পুষ্টি এই কুসুম থলি থেকেই আসে।
অন্যদিকে, মানুষের ডিম অনেক ক্ষুদ্র। কতোটা ক্ষুদ্র, তা কল্পনা করতে পারবেন, তার আকার জানলেই। মানুষের ডিমের আকার হচ্ছে এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ। পাখি এবং সরীসৃপদের মতো আমাদের ডিমের কোনো কুসুম কিংবা খোলস তৈরি হয় না। আমারা পুষ্টি এবং নিরাপত্তা পাই আমাদের মায়ের শরীর থেকে।
এখন, আপনার মনেই হতে পারে যে, যেহেতু মানবদেহে কুসুম সৃষ্টি হয় না, তাই হয়তো কুসুম থলি–ও তৈরি হয় না। না! কোনো এক কারণে—প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও, ভ্রূণের পরিস্ফুটনের সময় মানবদেহেও কুসুম থলি তৈরি হয়, এবং একসময় সেটা বিলুপ্তও হয়ে যায়। ঠিক এখানাটাতেই অবধারিতভাবেই মানবদেহে ফুটে ওঠে কোটি কোটি বছর আগের এক পূর্বপুরুষের চিহ্ন! এটাই স্বাক্ষ দেয়, আমার আপনার, আকাশে ওড়া পাখি কিংবা একটু আগে আপনার ঘরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সাপটির একটি একক ইতিহাসের।
কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদেরকে ডুব দিতে হবে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এক জগতে। আমাদের কোষের ডিএনএ-র অভ্যন্তে থাকা জিনোমে। কুসুম তৈরির অত্যাবশকীয় উপকরণ হচ্ছে, ভিটেলোজেনিন (vitellogenin) নামের একটি প্রোটিন। পাখি, ও সরীসৃপদের জনোমে পাওয়া যায় ভিটেলোজেনিন জিন (vitellogenin gene / VIT gene) ; যেটা ভিটেলোজেনিন প্রোটিন উৎপন্ন করে, যার মাধ্যমে ডিমের কুসুম গঠিত হয়। কথা হচ্ছে, আমাদের দেহেও কি আছে এই জিন?
যদি আমরা এমন কোনো পূর্বপুরুষ থেকে এসে থাকি, যাদের প্রজনন ঘটতো সুগঠিত কুসুমের, শক্ত খোলসের ডিম দেয়ার মাধ্যমে, তাহলে আমাদের ডিএনএ-তেও এর কোনো না কোনো অতীত চিহ্ন থেকে যাওয়ার কথা। আছে কি? সত্যি সত্যিই, ২০০৮ সালে বিখ্যাত সুইস ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এর অর্থায়নে এক গবেষণায় ঠিক তেমনটাই পাওয়া গেছে। আমাদের জিনোমে পাওয়া গিয়েছে কোটি বছর আগের সক্রিয় ভিটেলোজেনিন জিনের ভগ্নাংশ!
ঠিক যেভাবে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যগুলি দাঁড়িয়ে থাকে। এই গবেষণা পরিচালিত করা তিনজন প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডেভিড ব্রাওয়ান্ড, ওয়াল্টার ওয়াহলি, হেনরিক ক্যাসম্যান আমাদের জিনোমের সাথে পাখির জিনোমের তুলনা করে আরেকটা চমৎকার ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তারা দেখলেন, পাখির জিনোমে থাকা ভিটেলোজেনিন জিন এর পাশে যেসব প্রতিবেশী জিন আছে, আমাদের জিনোমে থাকা এই ভিটেলোজেনিন জিনের ভগ্নাংশের পাশেও হুবহু একই প্রতিবেশী জিনগুলি আছে! কোনো পরিবর্তন নেই!!
পাখির যেমন VIT1 এর পাশে আছে ELTD1 gene ; একই ভাবে মানব ডিএনএ তেও ELTD1 gene এর পাশেও আর কোনো জিন না—VIT gene এর ভগ্নাংশ! পাখির জিনোমের SSX2IP gene, CTBS gene এর পাশে VIT gene—একই ভাবে আমাদেরও SSX2IP gene, CTBS gene এর পাশে VIT gene এর ভগ্নাংশ!
এতো নিখুঁত সাদৃশ্যতা তখনই সম্ভব— যদি আপনি, আমি, অন্ধকারে গাছের মগডালে বসে থাকা ঐ হুতোমপেঁচা, আমরা সবাই যদি একই পূর্বপুরুষ থেকে আসি। আমাদের পুরো ডিএনএ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোটি বছরের ইতিহাস। কোনোটি স্বাক্ষ্য দেয় অতীত সংক্রমণের, কোনোটি স্বাক্ষ্য দেয় আমাদের পূর্বপুরুষের। আপনি বিবর্তন তত্ত্বকে গায়ের জোরে হয়তো কোনো না কোনোভাবে অস্বীকার করে ফেলবেন। কিন্তু, এই ক্ষুদ্র আণবিক পর্যায়ে এসে আপনাকে অবশ্যই প্রকৃতির এ মহিমান্বিত বাস্তবতার কাছে মাথা পেতে নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ