মালিক সমিতি ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি’র সমাবেশের আগের দিন থেকে বন্ধ থাকবে বাস। কিন্তু বাস বন্ধ হয়ে যায় তারও একদিন আগে। গতকাল থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় লঞ্চ চলাচল। বন্ধ মাইক্রোবাস ও তিন চাকার যানবাহনও। বিএনপি’র সমাবেশের একদিন আগেই পুরো বিচ্ছিন্ন বিভাগীয় শহর বরিশাল। অবরুদ্ধ নগরীর প্রবেশ পথে পুলিশের সতর্ক টহল-চেকপোস্ট। পাশের জেলাগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সতর্ক চোখ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়। এমন অবস্থায়ও থামিয়ে রাখা যায়নি জনস্রোত। শুধু নেতাকর্মীরা নয়, এসেছে সাধারণ মানুষও।
আনমনা হয়ে সমাবেশের মাঠে শুয়ে ছিলেন খলিল সরদার। সকাল ছয়টার দিকে মাঠে ঘুমানো মানুষের ছবি তুলতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে পড়েন তিনি। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গরম কাপড়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নাম-পরিচয় জানার পর জানা গেল ট্রলারে করে গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে বরিশালে পৌঁছেছেন। শীতের রাতে অনেকের সঙ্গে অবস্থান নেন মাঠে। অনেক কথার পর তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, এত কষ্ট করে কেন এলেন?
জবাবে খলিল সরদার বলেন, ‘এখন চাউলের কেজি ৬০ টাকা, ৭০ টাকা। চিনির কেজি কিনতে হয় ১২০ টাকা দিয়া। ডাল কিনতে হয় ১২০ টাকা দিয়া, তৈল কিনতে হয় ২০০ টাকা দিয়া। কাজ কইরা ভাত খাইতে পারতেছি না। তয় আমি কীভাবে চলব, কীভাবে খাব। এই জন্য আমি বিএনপির সাথে যোগ দিছি।’
জানা যায়, মো. খলিল সরদার (৬০) এসেছেন বাকেরগঞ্জ উপজেলার বড় রঘুনাথপুর থেকে। তাঁরা একসঙ্গে ১০০ জন এসেছেন। খলিল পেশায় একজন কৃষক। তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। বরিশাল নগরের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে (বেলস পার্ক) হওয়া সমাবেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই দুপুর ১২টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়েছে।
সমাবেশে একজন কৃষকের যোগদানে কি কোনো পরিবর্তন হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষক খলিল বলেন, ‘পরিবর্তন হইতেও পারে। আমার না হোক আমার ছেলেমেয়ের হবে। আমার মেয়েকে খুবই কষ্ট কইরা আমি পড়াইতাছি। এ বছর মাস্টার্সে ভর্তি হবে। ছেলেটাকে এ বছর বিএ পাস করাইছি। একটা মেয়ে নাইনে পড়ে। বাজারসাজার নিয়া হে গো চালাইতে আমার খুবই কষ্ট হইতেছে।’
খলিল সরদার জানান, সবকিছুর দাম বাড়তি। কাজেকর্মে, ব্যবসা-বাণিজ্যে কোথাও শান্তি নেই। সবদিকে মানুষ কষ্ট করছে। এলাকার পরিস্থিতি জানতে চাইলে খলিল সরদারের জবাব, ‘এলাকার পরিস্থিতি এ রকমই। আগে যারা ছিল ওইটা (আওয়ামী লীগ) এখন মনে করেন তারাও চলে আসছে যে আমাদের সামনে তো আরও দুর্ভাগ্য হইতে পারে, শেখ হাসিনা সাব (সাহেব) নিজের মুখেই বলছেন, সামনে আরও দুর্ভাগ্য (দুর্ভিক্ষ) হইত পারে। তই এখন আমরা সাধারণ পাবলিক দেখতাছি তো ঠিকই, আজকে দর হয় একটা, কালকে দর একটা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মালের দাম বাড়তি হয়।’
সরকার পরিবর্তন হলে কি দুর্ভিক্ষ কমবে? জবাবে খলিল বললেন, ‘দুর্ভাগ্য (দুর্ভিক্ষ) হয়তো কমে যাইতেও পারে। মনে করেন, এখানে দশের লগে থাইকা আগাই দেওয়ার জন্য আসছি আর কী।’
এদিকে পটুয়াখালীর লাউকাঠি থেকে সমাবেশে এসেছেন মরিয়ম বেগম। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তাকে উদ্যানের পূর্ব পাশে বসে খিচুড়ি খেতে দেখা যায়। পরিচয়ে জানা গেল, তিনি লাউকাঠি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। গত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। গত রাতে মাঠেই ছিলেন।
কীভাবে এলেন জানতে চাইলে মরিয়ম বলেন, ‘আইছি বড় কষ্ট কইররা। ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা, হাইট্টা আইছি, রিশকায় আইছি, অটোতে আইছি।’ কষ্ট কি সফল হবে? মরিয়মের জবাব, ‘অ্যা কইথারে আল্লায়। চেষ্টা তো করতে অয়।’
প্রায় ৮০ বছর বয়সী আবদুল মান্নান ফকির বানারীপাড়া থেকে এসেছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। চার কন্যাসন্তানের জনক মান্নান ফকির নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেও পরিচয় দেন। গতকাল বিকেলে তিনি মাঠে পৌঁছান। যাত্রাপথে বানারীপাড়া থেকে গড়িয়ারপাড় পর্যন্ত হেঁটে আসেন। বাকি পথ ভ্যানে করে বরিশালে পৌঁছান। রাতে মাঠেই ঘুমান। খাওয়াদাওয়াও করেন মাঠে।
কষ্ট করে সমাবেশে আসার কারণ জানতে চাইলে আবদুল মান্নান ফকির বলেন, ‘খালেদা জিয়ার জন্যই এত কষ্ট করতাছি। যে দেশটা কোথায় চইল্লা যাইতাছে। মাল-জিনিসের দাম এত বাড়াইয়া হালাইছে, আমরা ভাত খাইত পারি না।’
সকাল পৌনে সাতটার দিকে মাঠের মাঝ বরাবর একটি প্যান্ডেলে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা হয় জি এম শহিদুল ইসলামের। পরিচয়ে জানালেন, তিনি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা থেকে এসেছেন। শহিদুল ইসলাম পেশায় আইনজীবীর সহকারী। তিনিও ট্রলারে করে দিবাগত রাত দুইটায় বরিশাল পৌঁছান। তাঁরা ৭৪ জন একসঙ্গে ট্রলারে এসেছেন।
শহিদুল জানান, তিনি ৬ নম্বর বাজবাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। দলকে ভালোবাসেন, দলের স্বার্থে এসেছেন। মাঠেই রাত কাটিয়েছেন। কাঁধের ব্যাগটি দেখিয়ে এ-ও জানালেন, ভেতরে কাফনের কাপড়ও নিয়ে এসেছেন।
কাফনের কাপড় সঙ্গে রাখার কারণ জানতে চাইলে শহিদুল ইসলামের জবাব, ‘যদি মৃত্যু হয় এই কাফন দিয়েই দাফন করবে। আমরা সেই প্রস্তুতি নিয়া আসছি। আমরা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য শাহাদতবরণ করতে কোনো ভয় পাই না।’
এলাকায় ক্ষমতাসীনদের হাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন? উত্তরে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত হইছি না!, তিনটা মামলা আছে আমার মাথার ওপর।’
গোটা দেশেই যেন বিপ্লবের একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। সব বাধা পেরিয়ে সমাবেশে আসছে মানুষ। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বেশিরভাগ মানুষই পায়ে হেঁটে, মাছ ধরার ট্রলার, বালু টানার কার্গো ও বাইসাইকেল নিয়ে বরিশালে পৌঁছান। পরে তারা একত্র হয়ে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন বরিশাল। বাস, লঞ্চ, স্পিডবোট, মাইক্রোবাস সবই বন্ধ। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিভাগের বিভিন্ন জেলায় অসুস্থ রোগীরা উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
দুপুর ১টার দিকে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু উদ্যান। তীব্র রোদ, আর ধুলাবালি উপেক্ষা করে মাঠেই বালির উপর কেউবা সবুজ ঘাসের উপর বিছানা করে বসে পড়েন। অনেকেই নিজেদের অবস্থান জানান দিতে মাঠের চারপাশে শোডাউন করেন। স্থানীয় নেতারা নেতাকর্মীদের মাঝে বক্তব্য রাখেন। দুপুরের পর মিছিলে মিছিলে ঢল নামে সমাবেশস্থলে ও তার চারপাশের এলাকায়। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মাঠের চারপাশ দিয়ে প্রবেশ করেন নেতাকর্মীরা। সন্ধ্যা নামার আগেই পুরো মাঠ ভরে প্রধান প্রধান সড়ক ও নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নেন সমাবেশে আসা মানুষ। সন্ধ্যার পর বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে হিমশিম খেয়েছেন
এসডব্লিউএসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ