সারাদেশে সরকারি-বেসরকারকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার। সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটা স্কুলে সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত চর্চা করানো হবে।
দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা করার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা করছে সরকার। এরই মধ্যে ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রম পরিচালনা নীতিমালা- ২০২০’ এর খসড়া করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।নীতিমালায় এ কার্যক্রমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক চর্চা বলতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড বোঝাবে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত চর্চা বিশেষ করে দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক সঙ্গীতসহ বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজ সঙ্গীত রয়েছে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় এবং প্রয়োজনে সরাসরি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্বাচন করবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলায় সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় নির্বাচন করে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে তালিকা প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবেন।
জেলা প্রশাসক নীতিমালা অনুযায়ী জেলা কমিটির সভা করে উপজেলা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে জেলায় সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রম পরিচালনা করার উপযুক্ত বিদ্যালয় অগ্রাধিকারভিত্তিতে নির্বাচন করে পূরণ করা ফরমসহ তালিকা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ তালিকা থেকে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে বিদ্যালয় নির্বাচন করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রমের তালিকাভুক্ত করবে। এক্ষেত্রে দেশের সব উপজেলায় যৌক্তিকভাবে সমতাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নীতিমালা জারির আগে যেসব বিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেসব বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রম বাস্তবায়নে নীতি নির্ধারণ, দিকনির্দেশনা ও অনুমোদনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি থাকবে। ১০ সদস্যের জাতীয় কমিটির উপদেষ্টা হবেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী এবং সভাপতি হবেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব।
এ কমিটি বছরে অন্তত একবার সভা করে নতুন বিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা হালনাগাদ করবে এবং কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে।
এছাড়া সিটি করপোরেশন এলাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরাসরি নির্বাচন ও তদারকির জন্য এবং উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তালিকা থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্বাচন ও তদারকির জন্য জেলা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটির সভাপতি হবেন জেলা প্রশাসক।
জেলা কমিটিকে বছরে অন্তত একবার সভা করে সভার সিদ্ধান্ত ও পর্যালোচনা প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিদ্যালয়কে প্রাথমিকভাবে মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হারে একটি হারমোনিয়াম ও একসেট তবলা কেনার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। জেলা প্রশাসক জেলা কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশিক্ষক ও তবলা সঙ্গতকারী নিয়োজিত করবেন। বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চার প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষক এবং তবলা সঙ্গতকারীকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক মঞ্জুরি খাত থেকে নির্ধারিত হারে মাসিক সম্মানী দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রশিক্ষকরা সপ্তাহে একদিন দুই ঘণ্টা সাংস্কৃতিক চর্চার প্রশিক্ষণ দেবেন। ওই দিনটিকে ওই বিদ্যালয়ের জন্য কালচারাল ডে হিসেবে গণ্য করা হবে। সাংস্কৃতিক চর্চার প্রশিক্ষণ দিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ব্যবস্থা নেবেন।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয়গুলোর প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে জেলা প্রশাসন প্রতি বছর একবার সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে। উপজেলা পর্যায়ে বিজয়ী প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে জেলা পর্যায়ে, জেলা পর্যায়ে বিজয়ী প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে এবং বিভাগীয় পর্যায়ে বিজয়ী প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে একটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হবে।
সাংস্কৃতিক চর্চায় অংশগ্রহণকারী প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে উৎসাহ সঞ্চার করতে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলোতে (যেমন- একুশে পদক, নজরুল জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী, রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী বা অন্য কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উৎসব) বিভিন্ন বছর কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজয়ী প্রশিক্ষণার্থীদের পর্যায়ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
খসড়া নীতিমালার পটভূমিতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংস্কৃতিমনষ্ক করে গড়ে তুলতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে প্রাথমিকভাবে ১৮টি জেলায় জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ১০টি করে ১৮০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতিটি বিদ্যালয়কে একটি হারমোনিয়াম ও এক সেট তবলা কেনার জন্য অর্থ মঞ্জুরি দেয়া হয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
প্রশিক্ষণ দিতে প্রশিক্ষক এবং তবলা সঙ্গতকারীকে মন্ত্রণালয় নির্ধারিত হারে সম্মানী দেয়া হয়। জেলা প্রশাসনের পাঠানো প্রতিবেদনে জানা যায়, যে সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় এ কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে সেসব বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে স্থানীয়, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রমের আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে পটভূমিতে উল্লেখ করা হয়।
সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মী ও বিষেষজ্ঞ মহল। তারা মনে করেন, শিশুর সাংস্কৃতিক বিকাশের সাথে সমাজ রাষ্ট্র সর্বোপরী পৃথিবীর সুস্থ অগ্রগতি নিহিত। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়াতে পারলে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটবে, দেশ থেকে মাদক দ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণও কমে আসবে। সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালু করার দাবি জানান তারা।
আপনার মতামত জানানঃ