এ দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাস অনেক পুরোনো। বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই এর সূচনা। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতনের পরে বাংলাদেশে আইনের শাসন নির্ভর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হওয়ার যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় অচিরেই। আর সেই পরম্পরা ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ। হত্যা আর শক্তি প্রদর্শনকে মূলমন্ত্র করে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে চেষ্টা আওয়ামী লীগ গত প্রায় ১৩ বছর ধরে করে আসছে, তার বীজ ছড়িয়ে পড়েছে দলটির অস্থিমজ্জায়। আর এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফরগটেন ফ্রেন্ড রেপটাইল নামক এক স্যাঙ্কচুয়ারিতে কিংস্নেক প্রজাতির একটি সাপ যেভাবে নিজের লেজে কামড় বসিয়ে খেয়ে ফেলার চেষ্টা করছিল, অমনটাই ঘটছে আওয়ামী লীগের সাথে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ বছরের রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতদের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের হিসাবে, চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের অন্তঃকোন্দলে ৭৩টি সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আটজন নিহত এবং ৮৯৫ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপির অভ্যন্তরীণ ১৭টি সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ২১১ জন আহত হয়েছেন।
বছরের প্রথম ৯ মাসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ৬১ সংঘর্ষে ছয়জন নিহত ও ৮০১ জন আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুবলীগের একটি সংঘর্ষে তিনজন আহত, ছাত্রলীগের একটি সংঘর্ষে একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। যুবলীগের নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ একটি সংঘর্ষে তিনজন আহত হয়েছেন। যুবলীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের তিনটি সংঘর্ষে ৩৮ জন আহত হয়েছেন।
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ ছয়টি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়েছেন। আসকের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৯ মাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৪৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষগুলোর পেছনেও দলীয় কোন্দলই বড় কারণ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
এখানে আরও একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যায়। আর সেটা হলো- বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৭৬টি। এ হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমলেও ২০২১ সালে তা আবার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ওই বছর ১৫৭টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা পূর্ববর্তী চার বছরের গড় সংখ্যার বেশি।
সম্প্রতি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে ভুগছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। অনেক এলাকায় গৃহবিবাদ সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। একই অবস্থা দলটির সহযোগী সংগঠনগুলোতেও। আলোচনায় আছে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগও।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার মতে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি রাজপথে নামার চেষ্টা করছে। সামনে এ চেষ্টা আরো বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে বিবাদ, হানাহানি বন্ধ করতে না পারলে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
এদিকে, আগামী ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ সম্মেলন উপলক্ষে জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও অধীন শাখা কমিটিগুলোর সম্মেলন জোরালোভাবে শুরু হয়েছে। এসব সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বাড়ছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর লালবাগ থানা ও অধীন ওয়ার্ডগুলোর সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতেই কয়েক দফায় সংঘর্ষে জড়ায় বিবাদমান নেতাদের অনুসারীরা। পরে আবারও সংঘর্ষের আশঙ্কায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর চকবাজার থানা ও অধীন ওয়ার্ডগুলোর সম্মেলন স্থগিত করা হয়। লালবাগ ও চকবাজার থানা নিয়ে ঢাকা-৭ সংসদীয় আসন। এ আসনের সংসদ সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে তীব্র কোন্দল রয়েছে।
আসনের সংসদ সদস্য হাজি সেলিম, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরসহ একাধিক নেতা দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। নেতাদের বিরোধের কারণে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন কর্মীরা। সম্মেলনকেন্দ্রিক সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানোর চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখেই দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়েছে। মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা চাচ্ছেন উপজেলা, থানাসহ অধীন শাখা কমিটিগুলোতে নিজের অনুসারী নেতারা পদ পান। তৃণমূলের নেতারা পক্ষে থাকলে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া সহজ হবে। এ হিসাব থেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা দলের পদে নিজের অনুসারীদের বসাতে জোরালো চেষ্টা করছেন।
গত সেপ্টেম্বরে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সঙ্গে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরোধ চলছিল। গত ২৮ আগস্ট দুই পক্ষের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন। মার্চে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মাহফুজ আলম লিটন সরদারকে পিটিয়ে জখম করে পংকজের অনুসারীরা। এর আগে বিভিন্ন সময় একাধিক সংঘর্ষে কয়েকজন নেতাকর্মী মারা যান।
সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্বের কারণেও অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হচ্ছে। গত মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দেবীদ্বারে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে হামলার শিকার হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারীরা এ হামলা চালিয়েছে। এর আগে গত ১৬ জুলাই জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সঙ্গে আবুল কালাম আজাদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। একটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে মতবিরোধে এ ঘটনার সূত্রপাত। এর জেরে দেবীদ্বারে দুই নেতার অনুসারীরা রাস্তা অবরোধ, মিছিলসহ পাল্টাপাল্টি নানা কর্মসূচি পালন করে।
গত আগস্টে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ১০ নেতাকর্মী আহত হন। কুমিল্লা শহরের ধর্মতলী রেলগেট এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটে। জুলাইয়ে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১৮ জন আহত হন। মে মাসে কক্সবাজারের উখিয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে চারজন আহত হন।
গত জুলাইয়ে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নেতাকর্মীদের কম উপস্থিতির বিষয়ে হতাশা জানান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণমানুষের সংগঠন। এ রকম একটি সম্মেলনে হাজারো মানুষের উচ্ছ্বাস থাকে; কিন্তু উপস্থিতি আমাকে হতাশ করেছে। আমার দেখা ২০ বছরে সবচেয়ে ছোট সম্মেলন হচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে, আপনারা ভালো বলতে পারবেন। সাংগঠনিক দুর্বলতা নাকি সাধারণ মানুষ আসেনি। কোনটা?’
গত এপ্রিলে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন। মার্চে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই সংঘর্ষে জড়ান দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দল টানা ক্ষমতায় রয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যে না পাওয়ার বেদনা রয়েছে। সামনে আবারও নির্বাচন আসছে। ফলে অনেক নেতাকর্মীই নিজেদের মূল্যায়ন আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। এ কারণে তৃণমূলে বিবাদ বাড়ছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অনেক বড় একটি দল, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে হাতে গোনা কয়েকটি থানায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। এটা খুবই সামান্য। আমরা দল গোছানোর কাছে ব্যস্ত আছি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাকর্মীরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলকে বিজয়ী করবেন।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ