অতিমারির ফলে প্রায় প্রতিটি দেশে লকডাউন হয়েছে। অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। প্রচুর মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। বহু মানুষ গরিব হয়েছেন। গরিব আরও গরিব হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে।
করোনা মহামারি, নানা সংকট আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জাঁতাকলে যখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা পিষ্ট, এমন সময়েও নতুন করে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে।
বিনিয়োগ ব্যাংক ক্রেডিট সুসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বিশ্বে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে ৪৬ হাজার। ফলে অতিধনীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার। প্রতিবেদনে ভাষ্যে, সম্পদের যেন বিস্ফোরণ ঘটেছে এ সময়।
ক্রেডিট সুসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাদের সম্পদের মূল্য ৫০ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি ডলার, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো, বাড়ির মূল্য বৃদ্ধি ও স্টক মার্কেটের উল্লম্ফন। আর গত দুই বছরে এই অতিধনীর সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। পারিবারিক সম্পদ বৃদ্ধিতে সবার শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র।
এরপরই আছে চীন, কানাডা, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। ভারতে গত দুই বছরে আম্বানি ও আদানি গোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধির চিত্র দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়—এই দুজন এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর কাতারে। এ সপ্তাহের শুরুতে আদানি কিছু সময়ের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনীর কাতারে উঠে এসেছিলেন। অথচ গত দুই বছরে ভারতের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে অতিধনীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার। এরপর ৩২ হাজার ৭১০ জন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে চীন।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের শেষভাগে বৈশ্বিক সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের সাপেক্ষে সম্পদ বৃদ্ধির হার ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে মুদ্রার বিনিময় মূল্যের বিষয়টি বাদ দিলে সম্পদ বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৭ শতাংশ—এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।
যুক্তরাষ্ট্রে অতিধনীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার। এরপর ৩২ হাজার ৭১০ জন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে চীন।
তবে সব শ্রেণির সম্পদ একই হারে বাড়েনি। শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদের পরিমাণ গত দুই বছরে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে তাদের হাতে থাকা মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৪ শতাংশ, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশ। তবে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের পরিমাণ ২০২১ সালে বেড়েছে—১ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মূলত আবাসনের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির কারণ হলো, কোভিড-১৯-এর সময় আর্থিক সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। তবে দীর্ঘ মেয়াদে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, উদীয়মান দেশগুলোর উঠে আসা।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, গত বছর মার্কিন ডলারধারী মিলিয়নেয়ার বা ১০ লাখ ডলারের মালিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫২ লাখ। ২০২১ সালে এদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ২৫ লাখ, যেখানে যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যাই হচ্ছে ৬ কোটি ৭০ লাখ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ চলাকালে বিশ্ব অর্থনীতিতে অতিধনীদের সম্পদ ফুলে–ফেঁপে উঠেছে, বিশেষ করে যারা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত। বৈশ্বিক পুনরুদ্ধারের গতি জোরদার হওয়ার সুবাদে আর্থিক বাজারগুলোয় চাঙাভাব দেখা দেওয়ার কারণে অন্যদের সম্পদ বেড়েছে।
মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মধ্যে খাদ্য প্রথম। সেই খাদ্যের জোগানের একমাত্র মাধ্যম কৃষি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখনো খাদ্যের অভাবে ধুঁকে মরছে। করোনা মহামারি যেন জ্বলে আসা আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। এতে নতুন দরিদ্র হয়েছে আরও অনেকে। তবে একদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ও খাদ্য সংকট বাড়লেও অন্যদিকে বিশ্বে বাড়ছে অতিধনীদের সংখ্যা। অল্প কিছু অতিধনী সাহায্য করলে বিশ্বের চলমান খাদ্যসংকট মেটানো সম্ভব বলে দাবি করেছেন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) পরিচালক ডেভিড বিসলি।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেছেন, এসব ধনকুবের যদি তাদের সম্পদের সামান্য অংশ দান করেন, তাহলে বিশ্বের বহু মানুষের মুখে দুমুঠো খাবার জুটবে। চাইলে অতিধনীদের কোনো একজনের একবারের দানেই বিশ্বজুড়ে অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষ প্রাণে বাঁচবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৯
আপনার মতামত জানানঃ