সারা দেশে শীতের তীব্রতা বাড়ছে। প্রতিদিনই তাপমাত্রা কমছে। দেশের বড় এলাকা জুড়ে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই শৈতপ্রবাহ থাকবে কয়েক দিন। তবে ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচন্ড ঠান্ডায় গ্রাম ও চরাঞ্চলের ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধদের কাহিল অবস্থা চলছে। ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ শীতজনিত নানা রোগ দেখা দিয়েছে। হাসপাতালগুলোয় এসব রোগীর সংখ্যাই বেশি।
মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়। সেদিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায় ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সিনিয়র আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে এবং টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, শ্রীমঙ্গল, যশোর, কুষ্টিয়া ও বরিশালে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘দু-একদিন এমন আবহাওয়া বিরাজ করবে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয়তো আর নামবে না। দু-একদিন পর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে।’
সাধারণত ব্যারোমিটারের পারদ ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়, ৬-৮ ডিগ্রির মধ্যে নেমে এলে মাঝারি ও ৪-৬ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়।
রোববার রাতে সংস্থার সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, সর্বনিম্ন ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। শনিবার রাজারহাটে ছিল ৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তেঁতুলিয়ায় ছিল ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
১৪ ডিসেম্বর থেকে দিনের অধিকাংশ সময়ে সূর্যের দেখা মিলছে না। ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকে চারপাশ। দুপুরের পর অল্প সময়ের জন্য সূর্যের দেখা মিললেও রোদের তীব্রতা নেই। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় শীতের প্রকোপ, ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে রাতে ঘন কুয়াশায় রাস্তাঘাট ঢেকে যায়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দিকে শীতের প্রকোপ বেশি। উপায় না পেয়ে বাড়িতে বাড়িতে খুড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষ। তীব্র ঠাণ্ডার কারণে বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। এতে রোজগারে ভাটা পড়ায় পরিবার নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।
গত দু’দিন ধরে দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করছে কুড়িগ্রামে। নদীভাঙনের শিকার রিকশাচালক ইব্রাহিম আলী বর্তমানে কুড়িগ্রাম রেল স্টেশনে খোলা জায়গায় প্লাস্টিকের বস্তা টানিয়ে ঝুপড়ি ঘরে সন্তানদের নিয়ে থাকছেন। আক্ষেপ করে তিনি জানালেন, ‘হামাকগুলাক কাঁইয়ো দেখে না।
মেম্বর-চেয়ারম্যানরা খোঁজখবর নেয় না। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান রহিম আহমেদ রিপন জানান, কুড়িগ্রামে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এদিকে পঞ্চগড়ে হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। রাত থেকে ভোর, ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত কুয়াশার পরিমাণ বেশি থাকে, কখনো আবার বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ে।
শহরের সিনেমা হল সড়কের আশপাশে শতাধিক নারী ও পুরুষ শ্রমিকের জটলা বেঁধে আছে। সেখানে ফুলতলা এলাকার বাবুল ইসলাম (৪৮) বলেন, আমি দুইদিন থেকে সময়মতো কাজে বের হতে পারছি না। ঠাণ্ডায় হাত ও পা অবশ হয়ে যাচ্ছে।
তুলারডাঙ্গা এলাকার হামিদুল ইসলাম বলেন, শীত মৌসুমে আমাদের কাজ কমে যায়। দুপুর ১২টার আগে মানুষ ঘর থেকে বের হয় না। শুধু আমাদের পেটের তাগিদে বের হতে হয়।
পৌরসভার কামাতপাড়া এলাকার সবজিচাষী আইনুল ইসলাম বলেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে সকালে মাঠে কাজ করতে গেলে কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছি। ঠাণ্ডায় আর কাজ করতে পারছি না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের গতকালের মানচিত্র অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রাম বিভাগ ছাড়া সব বিভাগেই শৈত্যপ্রবাহ বিস্তার লাভ করেছে। এরমধ্যে রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহের সব জেলায় শৈত্যপ্রবাহ বইছে। এছাড়া সিলেটের মৌলভীবাজার ছাড়া বাকি ৩ জেলা; খুলনার যশোর, মেহেরপুর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলা; ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলা এবং বরিশালের সদর ও ভোলা জেলায় শৈত্যপ্রবাহ বইছে। এ ৩৭ জেলার মধ্যে ১৬ জেলায় বইছে মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ এবং বাকিগুলোতে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ।
আবহাওয়া অধিদফতর থেকে জানা গেছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত নদী অববাহিকতায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা থাকতে পারে। দেশের অন্যস্থানে হালকা থেকে মাঝারি কুয়াশা থাকতে পারে। এ অবস্থায় দেশের আমন ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও বীজতলায় পোকার আক্রমণ দেখা দিবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে শীতের দাপট মূলত চলে জানুয়ারি মাসজুড়ে। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি সৈয়দপুরের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছিল। এর আগে ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ জানিয়েছেন, আপাতত এই শৈত্যপ্রবাহ তেমন তীব্র হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে চলতি মাসেই আরেকটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আবহাওয়া চিত্রের সংক্ষিপ্তসারে বলা হয়েছে, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এর বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত রয়েছে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ