দেশে মানুষের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। তারা আত্মহত্যা করে, দুর্ঘটনায় মারা যায়, ধর্ষণ চলে। সর্বোপরি যে রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্য ও ফ্যাসিবাদ বিরাজ করছে, তার কারণে মানুষ মুখ খুলতে অত্যন্ত ভয় পায়, কী বললে কী হবে-সেই আতঙ্কে থাকে। এই ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে প্রগতিশীল মানুষকে সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
শুক্রবার(০৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (কারাস) মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে এ সভার আয়োজন করা হয়। লেখক সংঘের এবারের সম্মেলনের স্লোগান ‘ভয়ের মাঝে অভয় বাজাও, সাহসী প্রাণে চিত্ত জাগাও।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এমন একজনকে সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হলো, যিনি খুনের মামলার আসামি। ছেলে সুপারিশ করে তাকে পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে। আগেরবার আরেকজনকে পুরস্কার দেওয়া হলো,তাঁর নামই কেউ শোনেনি। এগুলো সবই হচ্ছে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। পুঁজিবাদ মানবসভ্যতার সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে উল্লেখ করে এই ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, আমলাতন্ত্র সাহিত্যের শত্রু, কারণ এর পেছনে আছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের শয়তানের কারণে পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে। পুঁজিবাদকে পরাভূত করাই হচ্ছে সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবীদের কাজ। এর জন্য সমর্থন দরকার, সংঘ দরকার। পাঠাগারকে সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে, যেখানে বিতর্ক-নাটক-গান-খেলাধুলা থাকবে। এর সঙ্গে কিশোর আন্দোলনকেও যুক্ত করতে হবে। সারা দেশে সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করা আমাদের সবার কর্তব্য।
অর্থ, পদ, পুরস্কারের লোভ-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত একটা দেশ। সততা বলতে কিছু নেই। সুবিধাবাদ চরম আকার ধারণ করেছে। প্রগতির লোকদের মধ্যেও সুবিধাবাদ, লোভ, অসহিষ্ণুতা আছে।
বঙ্গীয় রেনেসাঁ জাগরণ আনতে পারেনি বলেও দাবি করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হয়েছে এবং সারা পৃথিবীতে বিরাজ করছে। সেই শক্তি অতি নির্দিষ্টভাবে পুঁজিবাদী শক্তি। পুঁজিবাদ সাহিত্য ও সংস্কৃতির শত্রু। একসময় পুঁজিবাদের প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। কিন্তু তার ভেতরে দুর্নীতি ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পুঁজিবাদ ভয়ংকর হতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে টেকেনি, তার কারণ পুঁজিবাদ অনেক বেশি ধূর্ত। এর বিষাক্ত প্রভাবে আজ সারা পৃথিবী জর্জরিত। পুরো ব্যবস্থাটা ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক। শয়তানের দক্ষতার সাহায্যে পুঁজিবাদ এখনো টিকে আছে এবং সভ্যতার সব অর্জন ধ্বংস করছে। সারা পৃথিবীতে লেখকদের সংগ্রাম এর বিরুদ্ধে। আমাদের কাজ হবে একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ আনা।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূল স্তম্ভের (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) কোনোটিই আমাদের দেশে সাফল্যের কাছাকাছিও যেতে পারেনি। ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা শহরগুলোতে উন্নয়নের নামে নিসর্গকে ধ্বংস করা সরকারের একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাল-বিলগুলো ভরাট করে সেখানে সুপারমার্কেট-বাজার ইত্যাদি করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সারা দেশটা যেন একটা দোকান। একটা দোকানসংস্কৃতির জয়যাত্রা চলছে এই দেশে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লিটল ম্যাগাজিন হচ্ছে সব লেখকের সূতিকাগার। সেই আন্দোলনটাকে আবার ফেরত আনতে হবে।’
প্রচণ্ড লোভ বাংলাদেশের আত্মা ও লেখকদের বিনষ্ট করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান সৈয়দ আজিজুল হক। তিনি বলেন, ‘অর্থ, পদ, পুরস্কারের লোভ-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত একটা দেশ। সততা বলতে কিছু নেই। সুবিধাবাদ চরম আকার ধারণ করেছে। প্রগতির লোকদের মধ্যেও সুবিধাবাদ, লোভ, অসহিষ্ণুতা আছে। সমাজকে সুস্থ জায়গায় নিতে হলে আমাদের এই লোভের বিরুদ্ধে এবং সততা-নৈতিকতা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে আমরা বিভক্ত করি। কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ের মধ্যেই অন্যায় আছে। ফলে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বাইনারি দিয়ে আমরা সমাজকে বিচার না করি।’ মৌলবাদীদের পাশ্চাত্যবিরোধিতা আর প্রগতিশীলদের পাশ্চাত্যবিরোধিতার পার্থক্য স্পষ্ট করতে না পারলে প্রগতিশীলদের আন্দোলন সফল হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া পিনুর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দীপংকর গৌতম, চতুর্থ জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক শামসুজ্জামান হীরা প্রমুখ বক্তব্য দেন। আলোচনা সভার আগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে লেখক সংঘের চতুর্থ জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর টিএসসি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত একটি শোভাযাত্রা করা হয়। শোভাযাত্রাটি শাহবাগ ঘুরে টিএসসি হয়ে কারাস মিলনায়তনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে আলোচনা সভা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ