বিভিন্ন সমাজে নারী নিগ্রহের আরেক হাতিয়ার হচ্ছে ‘ডাইনি’ অপবাদ। সাধারণত অনুন্নত, গ্রামীন ও আদিবাসী সমাজের নারীদের ওপরই এ জাতীয় অপরাধ ঘটনাগুলো বেশি দেখা যায়। তথাকথিত এসব ‘ডাইনি’ নারীদের ওপর চলে সীমাহীন নির্যাতন এবং অনেক সময় পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তাদেরকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে নিত্যদিনই এসব ডাইনিদের শায়েস্তা করার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
ভারতের ঝাড়খণ্ডের রাঁচীর এক গ্রামে ডাইনি অপবাদ দিয়ে তিন নারীকে পিটিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পরে পুলিশ এসে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে।
জানা যায়, কয়েকদিন আগে গ্রামের এক কিশোরকে সাপে কাটা থেকে ঘটনার সূত্রপাত। সাপের কামড়ে ওই কিশোরের মৃত্যু হলে এক ওঝাকে ডেকে আনা হয়েছিল। তিনিই এসে ঘোষণা করেন, গ্রামে ‘ডাইনি’ আছে। তিনি গ্রামবাসীদের বলেন, যে বাড়িতে ডাইনি আছে তার বাড়িতে দু’এক দিনের মধ্যেই কোনো একটি ঘটনা ঘটবে।
কাকতালীয়ভাবে ওই ঘটনার পরের দিনই গ্রামের আরেক তরুণকে সাপে কামড়ায়। যা দেখে ভয় পেয়ে যান গ্রামবাসীরা। তারা ওই তরুণের মা রাইলু দেবীকে ডাইনি সন্দেহে আক্রমণ করেন। এর সাথে আর কেউ যুক্ত কি না তাও জানাতে বলেন।
স্থানীয় সূত্রে খবর, রাইলুই গ্রামের আরও দুই নারী ধোলি দেবী এবং আলোমানি দেবীর নাম করেন। তারপরই তিন জনকে ‘শাস্তি’ দিতে পাহাড়ে নিয়ে যান গ্রামবাসী। তিনজনকেই অত্যাচার করে ফেলে দেওয়া হয় পাহাড় থেকে।
কয়েকদিন আগে গ্রামের এক কিশোরকে সাপে কাটা থেকে ঘটনার সূত্রপাত। সাপের কামড়ে ওই কিশোরের মৃত্যু হলে এক ওঝাকে ডেকে আনা হয়েছিল। তিনিই এসে ঘোষণা করেন, গ্রামে ‘ডাইনি’ আছে।
ভারত আধুনিক হচ্ছে, হরহামেশাই সে দাবি শোনা যায়। কিন্তু সেখানে এখনো চলছে ডাইনি অপবাদে হত্যা। শুধু একটি রাজ্যেই ২২ বছরে হত্যা করা হয়েছে সহস্রাধিক লোকজনকে, যাদের সিংহভাগই নারী। এমনকি এ বছরের প্রথম মাসেই এভাবে হত্যার শিকার হয়েছে পাঁচজন।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঝাড়খণ্ড রাজ্যে গত ২২ বছরে ডাইনি অপবাদে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত সাত বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনা ৩৫টি। ২০২২ সালের প্রথম মাসে এমন কুসংস্কারের কারণে আক্রান্ত হয়েছে পাঁচজন, যাদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
সিআইডির রিপোর্টে বলা হয়, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও রাজ্যে রাজ্যে ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুন বা মারধরের অভিযোগ শোনা যায় প্রায়ই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ঝাড়খণ্ড। ২০০০ সালে বিহার থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঝাড়খণ্ড। ২০২১ সালে শুধু এই অংশেই ২৪ জন এমন কুসংস্কারের শিকার হয়েছেন।
সিআইডির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে ডাইনি সন্দেহে ৪৬ জন নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে ৩৯, ২০১৭ সালে ৪২, ২০১৮ সালে ২৫, ২০১৯ সালে ২৭ এবং ২০২০ সালে ২৮ জন এই কুসংস্কারের বলি হয়েছেন। ২০২১ সালের পুরো তালিকা এখনও আসেনি। তবে পুলিশের খাতায় এমন ২৪টি খুনের মামলা হয়েছে। গত সাত বছরে ঝাড়খণ্ডে ২৩০ জনের মৃত্যুর কারণ হলো ডাইনি অপবাদ। গত ২২ বছরে সংখ্যাটা এক হাজারের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হামলার পেছনে কুসংস্কার ও অন্ধ-বিশ্বাস কাজ করে। তবে কখনো কখনো সম্পত্তির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগ এনে বিধবাদের হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটে।
‘ডাইনি অপবাদে’ হত্যা প্রতিরোধে ভারতে জাতীয় স্তরে কোনও পৃথক ও সুনির্দিষ্ট আইন নেই। একই সঙ্গে এই ধরনের অপরাধগুলো দলবদ্ধভাবে হওয়ার কারণে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে; শাস্তি তো অনেক দূরের বিষয়। ফলে ভারতে যুগের পর যুগ ধরে অবলীলায় চলে আসছে এসব হত্যাযজ্ঞ। অনেক সময় ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও সমাজের ক্ষমতাবানরা নারী ও প্রতিপক্ষকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে পরাস্থ করে থাকে।
এর প্রতিকার হিসাবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভারতীয় অর্থনীতির সুফল দেশের প্রান্তিক আদিবাসী অঞ্চলে পৌঁছায়নি৷ পিতৃতন্ত্র, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, প্রশাসনের উপেক্ষা এবং সামাজিক সচেতনতার অভাবের মিলিত কারণ এই ডাইনি অপবাদ৷ তাই প্রতিকারের জন্য দরকার লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, তৃণমূল স্তর থেকে নীতি প্রণয়ন, প্রচার অভিযান জোরদার করা, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা এবং সর্বোপরি, কড়া আইন প্রণয়ন করা৷
সারা বিশ্ব যখন মানবাধিকার বিশেষ করে নারী অধিকার রক্ষায় সোচ্চার তখন ভারতের মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে অসহায় নারীদের ওপর চালানো বর্বরতা রোধে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার তড়িৎ পদক্ষেপ নিবে সেটাই কামনা সবার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ