কিছুদিন আগে লিখেছিলাম, ফসিল থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বোঝা গেছে, পোকামাকড় পৃথিবীর আদি বাসিন্দা। ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে কার্বোনিফোরাস যুগে এসেছিল তেলাপোকারা। ডায়নোসর, ফুলেল উদ্ভিদ, ম্যামালসদের অনেক আগে। ১৮৮০ র দশকে বিজ্ঞানীরা বলে গেছেন, পিঁপড়ার সমাজ নির্মাণের অভ্যাস এসেছিল ৫ মিলিয়ন বছর আগে। কিন্তু হুইলার ১৯১০ সালে বলেছেন তা আরো পুরনো, ৬৫ মিলিয়ন বছর আগের। আর এতবছর ধরে তা কোনভাবেই পরিবর্তিত হয়নি। মানে মানুষের সভ্যতা পৃথিবীতে একমাত্র সভ্যতা তো নয়ই, সবচেয়ে প্রাচীনও নয়।
বহুবছর ধরে পোকামাকড় তাদের পৃথিবীতে টিকে থাকার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। মানুষ সেখানে সবে বড় পরিসরে সহযোগিতা শুরু করেছে। তবে পোকামাকড় মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে যা করেছে, মানুষ তার চিন্তা করার ক্ষমতার বদৌলতে সেসব অর্জন করেছে অনেক দ্রুতগতিতে। পিঁপড়ার জ্ঞান অতীতেই শুধু তাদেরকে দীর্ঘসময় টিকিয়ে রাখেনি, ভবিষ্যতে টিকে থাকার উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছে। তবে শাপলে পিঁপড়ার ব্যাপারে যতটাই আশাবাদী ছিলেন, মানুষের ব্যাপারে ছিলেন ততটাই হতাশ। মানুষ একেতো অনভিজ্ঞ, তার উপর আবার তাড়াহুড়াপ্রবণ। সেইসাথে ধ্বংসের প্রতি মানুষের আছে অপ্রতিরোধ্য এক ঝোঁক। এই অদ্ভুত মানসিকতা মানুষকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারে।
তবে এবার যে মানুষের এই বিলুপ্তিকে বেগবান করতে উঠে পড়ে লেগেছে পিঁপড়া। তবে এই পিঁপড়া দৈত্যাকার কিছু নয়, প্রযুক্তিতে মানুষকে টেক্কা দেওয়ার সামর্থ্যও নেই তাদের। আমরা যেমন ছোটো পিঁপড়া দেখে অভ্যস্ত, আক্রমণকারী এই পিঁপড়ার আকারও ঠিক তেমনই। দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ মিলিমিটার। তবে বিষক্রিয়ায় অত্যন্ত নিপুণ তারা।
গরু, ছাগল-সহ অন্যান্য গবাদি পশু থেকে শুরু করে হাঁস, মুরগি এমনকি বিষধর সাপকেও অনায়াসেই মেরে ফেলতে পারে এই বিশেষ পিঁপড়ার প্রজাতি।
ইয়েলো ক্রেজি অ্যান্ট (Yellow Crazy Ants)। অবশ্য বিজ্ঞানীদের কাছে তা পরিচিত অ্যানোপ্লোলেপিস গ্রাসিলিপেস নামে। বাঘ, সিংহ, বিষধর সাপ কিংবা কিলার হোয়েলের পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে ১০০টি ভয়াবহ আক্রমণাত্মক প্রজাতির তালিকাতেই রয়েছে এই বিশেষ প্রজাতিটি।
আর এই তালিকা প্রস্তুত করেছে বিশ্বের অন্যতম বিজ্ঞান সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার। কিন্তু আকার-আয়তনে কয়েক লক্ষগুণ বড়ো প্রাণীদের কীভাবে ঘায়েল করছে এই ছোট্ট প্রাণীটি? কেনই বা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে তারা?
এন্টেমোলজিস্টদের কথায়, এই বিশেষ প্রজাতির কোনো নির্দিষ্ট ডায়েট নেই। প্রায় সমস্ত জীবিত ও জৈব পদার্থকেই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে ইয়েলো অ্যান্টরা। পাশাপাশি নাম থেকেই অনুমান করা যায়, তাদের গতিবিধিও অনির্দিষ্ট। আকস্মিক কোনো প্রাণীকে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করে বলেই তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ক্রেজি’ শব্দবন্ধটি।
তবে আমাদের চেনা পিঁপড়া প্রজাতিগুলির মতো এই পিপড়ে দংশন করে না। বরং, দূর থেকে অনেকটা স্প্রে-এর ভঙ্গিতেই ছুঁড়তে থাকে ফর্মিক অ্যাসিড। কয়েক হাজার পিঁপড়ার ছোঁড়া ফর্মিক অ্যাসিডের বৃষ্টিতে একপ্রকার গোসল হয়ে যায় শিকারের। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রিয়া শুরু হয় সংশ্লিষ্ট প্রাণীটির ত্বকে। ক্রমশ অবশ হতে থাকে দেহাংশ। পরিণাম মৃত্যু। অনেক সময়, আকারে বড়ো প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রাণ বাঁচলেও, ভয়াবহ ক্ষত সৃষ্টি হয় তাদের দেহে।
ঠিক এই ঘটনাই ঘটে চলেছে দক্ষিণ ভারতে। ইয়েলো ক্রেজি অ্যান্টের আক্রমণে যেমন একদিকে মারা যাচ্ছে হাঁস-মুরগি, তেমনই দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে গরু-ছাগল কিংবা শূকরের মতো প্রাণী। দু-একটি বিষাক্ত সাপ এবং বন্য খরগোশের মৃতদেহও আবিষ্কার করেছেন স্থানীয়রা।
তাছাড়াও বিপর্যস্ত হচ্ছেন কৃষকরাও। নষ্ট হচ্ছে বিঘার পর বিঘা জমি ফসল। আশঙ্কার বিষয় হল, দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এই বিশেষ পিঁপড়ার প্রজাতি। ফলে, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি আগামীতে বন্যপ্রাণীদের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলেই আশঙ্কা এন্টেমোলজিস্টদের।
রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারেই একমাত্র দমন করা সম্ভব এই ভয়ঙ্কর প্রজাতিটিকে। এখন দেখার বিশেষজ্ঞরা কী সমাধান তুলে দেন সাধারণ মানুষের হাতে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮৫৯
আপনার মতামত জানানঃ