রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে ওঠেছে। যার কারণে ইতিমধ্যে চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। লোকসান এড়াতে দেশে সকল জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে সরকার।
হঠাৎ করে এই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। এর প্রভাব পড়েছে সব ধরনের দ্রব্যমূল্যে। এমন পরিস্থিতিতে কম দামে জ্বালানি তেল কিনতে রাশিয়ার দিকে হাত বাড়াচ্ছে সরকার। যদিও এর আগে রাশিয়া তেল বিক্রির আগ্রহ দেখালেও এগোয়নি বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা হয়। সভায় রাশিয়া থেকে তেল আমদানি নিয়ে আলোচনা ওঠে।
বৈঠকে কীভাবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা যাবে, তা পর্যালোচনা করে দেখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি পারে, বাংলাদেশও রাশিয়া থেকে তেল কিনতে কেন পারবে না সেই প্রশ্নও করেছেন সরকারপ্রধান।
জানা গেছে, রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের নানা রকম নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। ফলে তেল কেনার গ্রাহক খুঁজছে দেশটি। গত সপ্তাহে বাংলাদেশের কাছে আবারো পরিশোধিত তেল বিক্রির প্রস্তাব পাঠায় রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিপণন কোম্পানি রজনেফ্ট।
এর আগে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল রাশিয়া, কিন্তু তা কিনতে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এবার দিয়েছে পরিশোধিত তেলের প্রস্তাব, আর তা কিনতে আলোচনা শুরু করছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির বিষয়ে আলোচনা করতে কমিটিও গঠন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।
বিপিসি সূত্র বলছে, বর্তমানে প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) ডিজেল আমদানি করতে ১২৫ ডলারের মতো খরচ পড়ছে বিপিসির। অপরিশোধিত ক্রুড অয়েল আনতে খরচ পড়ছে ৯০ ডলার। তবে প্রতি ব্যারেল ডিজেল মাত্র সাড়ে ৫৭ ডলারে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে দেবে রাশিয়ান তেল উৎপাদন ও বিপণন কোম্পানি ‘রজনেফ্ট’। সেই হিসাবে প্রতি লিটার ডিজেলে আমদানি খরচ পড়বে ৪০ টাকারও কম।
বর্তমানে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি পর্যালোচনার করা হচ্ছে। বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের (রাশিয়ান কোম্পানি) পক্ষ থেকে একাধিক প্রস্তাব এসেছে। এরমধ্যে একটি প্রস্তাব হলো- তারা চট্টগ্রাম বন্দরের কাস্টমস পয়েন্টে ডিজেল পৌঁছে দেবে। এর দাম পড়বে প্রতি টন ৪২৫ ডলার। ১৫৯ লিটারে ব্যারেল হিসাব করলে ব্যারেলপ্রতি দাম পড়বে ৫৭ দশমিক ৪৩ ডলার। এ নিয়ে কাজ করছে সরকার।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘কাজ চলছে। সরকার চাচ্ছে সংকট সমাধান করতে। আমাদের কমিটি সব পর্যালোচনা করে সরকারকে জানাবে। যেটা ভালো মনে হয়, সেই সিদ্ধান্তই সরকার নেবে। তার পরেই রাশিয়ার সঙ্গে চূড়ান্ত আলাপ হবে। যদিও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে, সেটা সরকার বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে।’
এছাড়া কিছুদিন আগেই বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছিলেন। ওইদিন তিনি বলেন, ‘বিপিসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি আলোচনা করছে।’
বিষয়টা যেভাবে দেখছে ইইউ
তবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বলছেন অনেকে। উপমহাদেশে ভারতের অবস্থান সুদৃঢ়। অন্যদিকে চীনের কর্তৃত্ব অনেকটাজুড়ে। কাজেই বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত বা চীন যা করতে পারবে চাইলেই বাংলাদেশের পক্ষে তা করে দেখানো সম্ভব নয়। সেটা করতে যাওয়াটাও বোকামি হবে বলে মনে করেন অনেকে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা আমাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে কি হবে না তার চেয়ে জরুরি হচ্ছে আদশর্গত দিক থেকে কোনোভাবেই বাংলাদেশের উচিত হবে না এই তেল নেওয়া। অথর্নীতি বিচারে, একদিকে এই তেল নিয়ে আমাদের যে লাভ হতে পারে তারচেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, তেল নেওয়ার কারণে ইউরোপের দেশগুলো বা যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা আমরা সামাল দিতে পারবো না। আমাদের অথর্নীতি দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্টসের ওপর। তাই ক্রেতাদের খেপিয়ে তেল কেনা মোটেই লাভজনক হবে না।
যদিও গত জুলাই মাসে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানি করলে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সফররত প্রতিনিধিরা। তখন তারা বলেন, এতে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না।
ওই সময় তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিটির ৬ সদস্যের প্রতিনিধি। তখন কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন-ডিকাবের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তারা। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিনিধি দলটি জানায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা এখনই বন্ধ করা উচিত। কারণ এ যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে, প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বাংলাদেশ। ইইউ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিটির সদস্য ম্যাক্সিমিলান কারাহ বলেন, শান্তিপূর্ণ অবস্থান রক্ষায় আমাদেরকে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধ করতে এটা সহায়ক হবে বলে মনে করে ইইউ।
তবে জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজের মত সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কোন প্রভাব পড়বে না বলে আমরা আশ্বস্ত করছি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ