২০০৯ সাল থেকে টানা ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সময় তিন তিনটি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ভাবে বিজয়ী হয়েছে। বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই হোক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগ নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের সাথে প্রকাশ্য-গোপন সখ্যতা গড়ে বিএনপি-জামায়াতকে এক ঘরে করেছে।
কিন্তু এই দীর্ঘ কৌশল এখন যেন অকেজো হয়ে গেছে। ক্রমশ ঘরে-বাইরে একলা হয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং আগামী নির্বাচনের আগে এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ক্রমশ আওয়ামী লীগ বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মেরুকরণে আওয়ামী লীগের কূটনৈতিক অস্পষ্টতা এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাবের কারণে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক মিত্ররা আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের অন্যতম ছিলো। বিশেষ করে এক-এগারোর পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো সেই নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ভূমিকা ছিলো এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রভাববলয়ে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে প্রায় এক বছর ধরে। এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে নানা রকম নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই কথাবার্তা বলছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো তৎপরতা নেই।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রদূত রয়েছেন তাকে বদল করা হয়েছে কিন্তু নতুন রাষ্ট্রদূত এখনো যাননি। বাংলাদেশে যে বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খোলাখুলি ভাবে কথা বলতে চায় সে সমস্ত বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশ কয়েক দফা আলোচনার চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ফলাফল আনতে পারেনি। বরং মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মার্কিন চাপ আরও বাড়ছে।
ইউরোপের দেশগুলো ছিলো আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় মিত্রদের একটি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার পর ইউরোপের দেশগুলোই প্রথম এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছিলো, নিন্দা জানিয়েছিলো। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশে মানবাধিকার, সুশাসন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা বলছে।
সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন রাষ্ট্রদূতকে মিথ্যাবাদী বলার পর ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে। একজন কূটনীতিক সম্পর্কে একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ রকম মন্তব্য করতে পারেন কিনা, সেই প্রশ্নও এখন কূটনৈতিকপাড়ায় আলোচিত হচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে ভালো এবং উষ্ণ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে ভারতও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং অসন্তুষ্ট বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারত সফর করবেন এবং সেই সফরে দু’দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনে জায়গাগুলো ঠিক করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে।
চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক পার্টনারদের একটি। কিন্তু চীনের সঙ্গে এখন বাংলাদেশে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ মোটামুটি একলা হয়ে গেছে। এই একাকীত্ব আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট এবং মহাজোটের মাধ্যমে একটি বাতাবরণ তৈরি করেছিলো। প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলোকে আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো যেন বিএনপি-জামায়াত একলা থাকে। এমনকি যে সমস্ত দলগুলো বিএনপির সঙ্গে ছিলো তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ একটা গোপন সখ্যতা তৈরি করেছিলো, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যার অন্যতম প্রমাণ।
কিন্তু সেই রাজনৈতিক কৌশলেও আওয়ামী লীগ যেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট ১৪ দল ভাঙ্গনের মুখে। ১৪ দলের নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের দায় তারা নিবেন না। লোডশেডিং, দিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে জোটের শরিকরা সরাসরি সরকারের বিরোধিতা করেছে।
অন্যদিকে, মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি জানিয়ে দিয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে মহাজোট এখন আর নেই। বাম দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের আগে থেকেই দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো, এখন সেই দূরত্ব আরও বেড়েছে। ইসলামপছন দলগুলো এখন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে না, বরং তারা বিএনপি এবং অন্য দক্ষিণপন্থীদের নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচনে দেড় বছরেরও কম সময় আগে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে একলা হচ্ছে সেটি উদ্বেগজনক বলে আওয়ামী লীগের নেতারাই মনে করছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগ বাড়ানো দরকার বলেও তারা ভাবছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ