ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ইতোমধ্যে খাদ্য সংকটের সতর্কতা জারি করেছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে দুর্ভিক্ষ। সেখানে প্রতিদিন শতাধিক শিশু মারা যাচ্ছে।
সোমালিয়া বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মধ্য দিয়ে একটি বিপর্যকর দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শস্যের দাম বাড়িয়ে সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যার অর্থ কৃষক এবং পশুপালকরা তাদের খাদ্যের পরিপূরক যোগাড়ে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে, দেশটির গবাদি পশুগুলি খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছে এবং ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে।
সোমলিয়ার প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বা জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ খাদ্যাভাবে ভুগছে এবং প্রায় ১৪ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, জরুরী পদক্ষেপ না নিলে এই দুর্ভিক্ষ ২০১১ সালের ২ লাখ ৫০ হাজার মৃত্যুর থেকেও বেশি বিপর্যকর হতে পারে।
সোমালিয়ায় জাতিসংঘের ফুড এন্ড ও এগ্রিকালচারাল ওর্গানাইজেশন (এফএও) কার্যালয় সাম্প্রতি বলেছে যে, হর্ন অফ আফ্রিকা জুড়ে ৮ লাখ ৮২ হাজার মানুষকে সহায়তা করার জন্য জরুরিভাবে ১ শ’ ৩১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
সংস্থাটি সোমালিয়ায় খরা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘অর্থায়নের মাত্রা খাতটিতে কম রয়েছে।’
তারা বলেছে যে, সোমালিয়ার ৯০টি জেলার মধ্যে ৫৫টিতে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় মাত্র ৪৬ শতাংশ অর্থায়ন সম্ভব হয়েছে।
সোমালিয়ায় ৯ লাখেরও বেশি মানুষ খরার কারণে এবং জীবিকার অভাবে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল অনুসারে, খরাজনিত অপুষ্টির কারণে জানুয়ারি থেকে সোমালিয়ায় ৫শ’রও বেশি শিশু মারা গেছে।
এফএও বলেছে, ‘আমরা দুর্ভিক্ষ ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে পারি না; জীবিকা ও জীবন রক্ষার জন্য আমাদের এখনই কাজ করতে হবে।’
দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ ও ইসলামপন্থী জঙ্গিদের তৎপরতার কারণে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে সোমালিয়ায়। গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন শহরের অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
সোমালিয়ায় টানা চার বছর ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। হলেও একেবারে কম। দেশটির আবহাওয়াবিদদের মতে, গত ৪০ বছরে এমন ভয়াবহ খরা দেখেনি সোমালিয়া। পানির অভাবে দেশটির কৃষি ব্যাবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, বিপুল সংখ্যক গবাদি পশু মৃত্যুও হয়েছে এই খরার কারণে। গৃহযুদ্ধ ও খরাজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে সোমালিয়ার বিভিন্ন শহরে বর্তমানে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ৬০ লাখ মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক ও মানবিক সহায়তা প্রয়োজন তাদের।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। গোটা বিশ্বের মনযোগ এখন ইউক্রেনের দিকে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও জাতিসংঘ সোমালিয়ার দুর্গতদের জন্য বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ ও ইসলামপন্থী জঙ্গিদের তৎপরতার কারণে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে সোমালিয়ায়। গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন শহরের অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
জাতিসংঘের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে সোমালিয়ায় খাদ্য সংকটজনিত কারণে যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে দেশটির ২০১১ সালের মহা দুর্ভিক্ষের তুলনা করা চলে। ওই দুর্ভিক্ষে সোমালিয়ায় আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং তাদের অধিকাংশই ছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে, সংঘাতে বিপর্যস্ত সোমালিয়ায় খরার কারণে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। সেখানে বিগত তিন ঋতু কম বৃষ্টিপাতের পরে চতুর্থ দফা বৃষ্টিপাত কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ বলেছে, বিগত ৩০ বছরে দেশটিতে কখনো টানা তৃতীয়বার বৃষ্টিহীন বর্ষাকাল দেখা যায়নি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সংঘাত নয় বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সোমালিয়ায় বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সোমালিয়া সংক্রান্ত জাতিসংঘ মানবিক সমন্বয়ক অ্যাডাম আবদেলমৌলা এক সাক্ষাৎকারে এএফপিকে বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পাঁচ বছর বা তার কম বয়সী ৩ লাখ শিশু গুরুতর অপুষ্টির ঝুঁকিতে পড়বে।
আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি এখনো স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারেনি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়েছে। এমনকিছু অঞ্চল রয়েছে যেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এখন পর্যন্ত। সামান্য কলেরায় হাজারো শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। জীবন মান উন্নয়ন ও শিক্ষার কোনো উদ্যোগ কাজে লাগতে পারেনি দেশটির সরকার। সে দেশের সেনাবাহিনী পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরাপত্তার কারণে সব অঞ্চলে যেতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ভিক্ষকবলিত অঞ্চলগুলো যদি জরুরি সাহায্য না পায় তাহলে অনাহারে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটবে৷ শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ তাদের মায়ের পুষ্টিহীনতা ও খাদ্যের অভাব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ