বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি মেনে চলার বিষয়টি চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর৷ চিঠিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে বিষয়টি মনে করানোর দরকার পড়েছে৷
গত ১৮ জুলাই চিঠিটি ঢাকার সব বিদেশি দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়৷ চিঠিতে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার রিলেশন নীতি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ভিয়েনা কনভেনশেন অনুযায়ী, রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়৷ তারা কী করতে পারবেন আর পারবেন না তা সেখানে বলা আছে৷
উল্লেখ্য, গত ১৩ জুন মন্ত্রিপরিষদ নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই চিঠি দিতে বলা হয়েছিল৷
চিঠিতে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘‘সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আমরা সকলকে সম্মানের সাথে বলতে চাই যে, কূটনীতিকরা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাদের কূটনৈতিক কার্যকলাপ যথাযথ কূটনৈতিক প্রোটোকল মেনে পালন করবেন৷”
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘‘কোনো দেশেরঅভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো, মতামত দেয়া কূটনীতিকদের কাজ নয়৷ এমনকি একটি দেশে বিদেশি কূটনীতিকরা কোথায় যাবেন, কার সাথে কথা বলবেন বা কাকে আমন্ত্রণ জানাবেন তা-ওওই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানাতে হয়৷ কিন্তু আমাদের এখানে সেটা মানতে দেখছিনা৷”
তিনি মনে করেন, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন,জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে হয়ত সরকার এটা চাচ্ছে না৷
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, সরকার হয়ত তার সক্ষমতা প্রকাশ করেছে এই চিঠির মাধ্যমে৷ বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিবর্তন আনছে৷
কূটনীতিকদের তৎপরতা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা তৎপরতা শুরু করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। সরকারের মন্ত্রী, নির্বাচন কমিশনসহ (ইসি) রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূতরা। তাদের আলোচনায় উঠে আসছে নির্বাচন প্রসঙ্গ। এদিকে বিদেশি কূটনীতিকদের নড়াচড়ায় বক্তব্য রাখছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও।
দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ‘বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া রাজনৈতিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ’ বলে তারা অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে ‘কোনও ক্ষমতাধর দেশেরও কিছু করার নেই’ বলে আওয়ামী লীগ নেতারা মন্তব্য করেছেন। অবশ্য বিদেশিদের এই তৎপরতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা পক্ষে-বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা গেছে, নির্বাচনের এক থেকে দেড় বছর আগে বিভিন্ন বিদেশি দূতরা নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন ইস্যুতে আলোচনা করে। রাজনীতিকদের সৌজন্যে ডিনারেরও আয়োজন করতে দেখা যায় প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর আগে সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর কূটনীতিকদের তৎপরতা জোরদার হয়েছে।
বর্তমান কমিশন গঠনের পর গত ৮ জুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২৬ জুন সাক্ষাৎ করেন অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুর। এরপর গত ৩ জুলাই একসঙ্গে ১৪টি দেশের রাষ্ট্রদূত যান ইসিতে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাইকমিশনের নেতৃত্বে অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ৩৮টি দেশের মধ্যে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, তুরস্ক এবং জাপানের রাষ্ট্রদূত ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই তিনটি সাক্ষাতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
সাক্ষাতে তারা আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু দেখতে চায় বলে জানিয়েছে। এজন্য তারা নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা দেওয়ারও আশ্বাস দেন।
এদিকে ৭ জুন ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগামী বছরের শেষে নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিদিন খবর প্রচার করছে। নির্বাচনের ব্যাপারে আমি সরকারের দিক থেকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি লক্ষ করেছি। আমি আশা করবো, গতবারের তুলনায় এবার ভালো, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার পদক্ষেপ নেবে।’ ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তারা উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গত ১৩ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এবং ১২ জুলাই জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে গিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অবশ্য দুটি সাক্ষাতের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপরে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
এর আগে গত ১৭ মার্চ জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারের সাথে বিএনপি নেতাদের সাক্ষাৎ হয়। অবশ্য ওই সাক্ষাতের আলোচনা নিয়ে বিএনপি নেতারা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে উল্লেখ করে অন্য একটি অনুষ্ঠানে জার্মান দূত বিরক্তি প্রকাশ করেন।
গত ৪ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)-র সাথে দেখা করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৪টি দেশের কূটনীতিকরা৷ বৈঠকের পর প্রতিনিধি দলের পক্ষে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড সাংবাদিকদের বলেন, তারা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনি পরিবেশ দেখতে চান৷ এজন্য তারা নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, দেশের গণতন্ত্র আরো কার্যকর ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে যে কোনো প্রকার সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছেন৷ ওইসিডি সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে আরো শাণিত করার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করতে চায়৷
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তখন জানান, ওটা ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ, নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো পরামর্শ দেননি৷ তারা নির্বাচনের আইন-কানুন ও প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন৷
ঢাকায়নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চালর্স হোয়াইটলি গত ২৪ জুলাই সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠক করেন৷ বৈঠক শেষে জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার এক টুইটে বলেন, স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা কূটনীতিকদের প্রধান দায়িত্ব৷ নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন টুইটে বলেন, স্বাগতিক দেশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে একজন কূটনীতিক সকল অংশীদারের সাথে যোগাযোগ রাখতে সব সময়ই চেষ্টা করেন৷
গত ২ জুন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার বাসভবনে নাগরিক সমাজের ৫ জন প্রতিনিধিকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান৷ ওই আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা)-র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতীর শারমিন সোনিয়া মুর্শিদ৷ তবে সেখানে বাংলাদেশের কোনো বিষয় নিয়ে কথা হয়েছি কিনা তা জানা যায়নি৷
গত ১৭ মার্চ ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা৷ গুলশান বিএনপির চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শামা ওবায়েদ৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০১
আপনার মতামত জানানঃ