১৯৯০-এর দশকে তালিবানের প্রথম শাসনমেয়াদে নারীদের জন্য কঠোর সব বিধিনিষেধ জারি ছিল। নারীদের কাছ থেকে প্রায় সব অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করার পর নিজেদের পূর্ববর্তী কঠোর নীতি নমনীয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। তবে প্রতিশ্রুতি রাখেনি তালিবান। আফগানিস্তানের সামাজিক জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে নারীরা।
আফগানিস্তানে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে গোঁড়ামি। ১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় মেয়াদে কাবুল দখলের পর পূর্বের মতো কট্টর না হবার আশ্বাস দিলেও, বাস্তবে তার উল্টো চিত্র। আবার জেঁকে বসেছে কট্টর তালিবান রাজ। মেয়েদের পড়ালেখা থেকে নারীদের কর্মস্থল সবখানেই ফতোয়া-নিষেধাজ্ঞা। বাদ পড়েনি সরকারি চাকরিজীবী নারীরাও।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচআরসি তালিবান সরকারের প্রতি আফগান নারীদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷ শুক্রবার এক প্রস্তাবে তারা বলছে, আফগান নারীদের সমাজ থেকে অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে৷
গত আগস্ট মাসে দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে তালিবান৷ এরপর থেকে সেখানকার নারীদের পোশাক, চলাফেরা ও শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা, যদিও শুরুতে বিপরীতই বলা হয়েছিল সংগঠনটির পক্ষ থেকে৷
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে তালিবানের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় আফগানিস্তানের কয়েকটি এলাকার নারীদের জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তালিবানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, তা যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তালিবান বলছে, যেসব কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ আলাদা করে কাজ করার সুযোগ আছে, শুধু সেসব জায়গাতেই নারীরা কাজের সুযোগ পাবেন। এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে কার্যত নারীরা চাকরিতে নিষিদ্ধ।
বিশেষ করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষার মতো খাতগুলো বাদ দিলে তাদের সরকারি চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে।
এর রেশ ধরেই, পুলিশ থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন প্রায় চার হাজার নারী। গার্ডিয়ানে দেওয়া আফগান পুলিশের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গুলফারোজ ইবতেখারের এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তালিবানরা প্রায় ৪০০০ মহিলা পুলিশ সদস্যের মধ্যে অল্পসংখ্যক সদস্যকে মহিলা কারাগার চালানোর জন্য রেখে বাকিদের চাকরিচ্যুত করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন নারীকল্যাণ সংস্থা বিলোপ করেছে তালিবান সরকার।
এমনকি বেসরকারি খাতে কর্মরত নারীরাও অফিসে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন। তালিবানের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রায়ই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেন। এসব প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষ আলাদাভাবে কাজ করার কঠোর রীতি মানা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
আফগানিস্তানে গত দুই দশকে পুলিশ থেকে আদালত পর্যন্ত সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছিল। তবে গত আগস্টে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর লাখো আফগান নারী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
তালিবান বলেছে, সব নারীরই শিক্ষা অর্জনের অধিকার রয়েছে। অথচ গত বছরের আগস্ট থেকে আফগানিস্তানের বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নারীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি।
তালিবানের প্রথমবারের শাসনমেয়াদে নারীদের জন্য বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। এবার ক্ষমতা দখলের পর তালিবান বলেছে নারীরা মাথায় হিজাব কিংবা স্কার্ফ পরলে চলবে।
গত মাসে তালিবানের নীতিনৈতিকতা-বিষয়ক মন্ত্রণালয় কাবুলের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নারীদের অন্তত হিজাব বা স্কার্ফ পরতে হবে। তবে এর সঙ্গে যে ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তা বোরকার ছবি।
পুরুষ স্বজন ছাড়া নারীদের এক শহর থেকে অন্য শহরে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে তালিবান। নারীদের মাথায় স্কার্ফ না দেখলে তাদের ট্যাক্সিতে না তোলার জন্য চালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তালিবান আগস্টে ক্ষমতা দখল করার আগে বিউটি পারলার ও বুটিক শপ দেখা যেত। সেগুলোর বেশির ভাগই এখন আর নেই। হেরাতে বিভিন্ন দোকানের ম্যানিকুয়িনের (দোকানে পোশাক সাজিয়ে রাখার পুতুল) মাথা ফেলে দেওয়া হয়েছে। যেসব বিলবোর্ডে মানুষের ছবি আছে, তা নামিয়ে ফেলা হয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নারী শিল্পী অভিনীত নাটক দেখানো বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নারী সাংবাদিকদেরও ক্যামেরার সামনে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তালিবানের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, নারীদের খেলাধুলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু নিজেদের সে ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক আছেন তারা। কারণ ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গনের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে সব লিঙ্গের মানুষকে খেলার অনুমতি দেওয়া জরুরি।
তালিবান ক্ষমতা দখল করার পর আফগানিস্তানের শীর্ষ সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী ও আলোকচিত্রীদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যারা দেশ ছাড়তে পারেননি, তারাও আত্মগোপনে রয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে চেক রাষ্ট্রদূত ভাস্লাভ বালেক বলেন, ‘‘২০২১ সালে আগস্ট মাস থেকে আফগানিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের জন্য।”
তিনি বলেন, ‘‘তালিবান এতটাই কড়াকড়ি আরোপ করেছে যে তারা আফগান সমাজ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সিদ্ধান্তের কারণে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতায় পড়বে না তালিবান৷ তবে এর রাজনৈতিক প্রভাব আছে৷ এমনকি এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক তদন্তের সুযোগও তৈরি করতে পারে৷
অনেকগুলো দেশের সম্মতি থাকায় শুক্রবারের সিদ্ধান্তটি কোনো ভোট ছাড়াই পাশ হয়েছে৷ তবে চীন নিজেকে এই সিদ্ধান্ত থেকে আলাদা রেখে বলেছে, ‘এটি ভারসাম্যপূর্ণ নয়’৷
সমর্থনকারীদের একজন আফগানিস্তানের আগের সরকারের দূত মহিবুল্লাহ তাইব৷ তিনি বলেন, তালিবানের নিষেধাজ্ঞাগুলো ‘নারীবিদ্বেষপ্রসূত’৷
আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে এ বিষয়ে একটি আলোচনা হবে৷ সেখানে আফগান নারী অধিকারকর্মীরা যোগ দিতে পারবেন৷
তবে এসব সিদ্ধান্ত বা চাপে তালিবান সরকার কতটা নমনীয় হবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ