রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চরম আঘাতে দরিদ্র দেশগুলোয় দেখা দিয়েছে খাদ্যপণ্যের কল্পনাতীত মূল্যস্ফীতি ও সেই সূত্রে খাদ্য সংকট। উন্নত বিশ্ব সব সময়েই ‘চাচা আপনি বাঁচা’ নীতিতে চলে; তা সে হোক ‘প্রাণ’ বা যেকোনো স্বার্থ। কোভিডের টিকা সহায়তা দেওয়া নিয়েও প্রথমদিকে তাদের গড়িমসি দেখেছে বিশ্ববাসী। তবে এবার সেই উন্নত বিশ্বও মূল্যস্ফীতির আঁচ থেকে বাঁচতে পারেনি। যার প্রমাণ যুক্তরাজ্যের রেকর্ড মূল্যস্ফীতি।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার বিশ্বের অন্যতম প্রধান দানাদার শস্য সরবরাহক। তাদের মধ্যে যুদ্ধের কারণে গত কয়েক মাস ধরে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের সতর্কবার্তা দিয়ে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু, তাতে পশ্চিমা দেশের সরকারগুলো কান দেয়নি। উল্টো যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে ইউক্রেনকে দেওয়া সামরিক সহায়তা বাড়িয়েছে। রাশিয়ার পরাজয়ই তাদের একমাত্র লক্ষ্য, এজন্য গরিব দেশের ওপর মূল্যের চাপের পরিণতিকে দেখেও না দেখার ভান করেছে তারা।
একবেলা খেতে পারবে না ৮১ কোটি মানুষ
এরমধ্যেই জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবিক ত্রাণ সহায়ক সংস্থাগুলো পৃথিবীব্যাপী অনাহার ও অপুষ্টিতে জীবনহানি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছে। এনিয়ে গেল সপ্তাহে আরও একবার সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ সংকট “কোটি কোটি মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রান্তে ঠেলে দিবে।” ফলে নজিরবিহীন অপুষ্টি ও ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে- যা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। আরও বেড়ে যাবে বৈশ্বিক মন্দার সম্ভাব্য ঝুঁকি।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রক্ষেপণ অনুসারে, প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অনাহারে ভুগতে চলেছে। রাতের আহার থেকে বাদ পড়বে অন্তত ৮১ কোটি মানুষ। খরা ও সহিংসতা পীড়িত আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের ঘটনা ২০১৯ সালের মহামারি পূর্ব সময়ের চেয়ে ১০ গুণ বাড়বে।
ইউক্রেন ও রাশিয়া বিশ্বের গম রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ করতো। তাদের অন্যান্য প্রধান কৃষি রপ্তানির মধ্যে আছে ভুট্টা, যব ও সূর্যমুখীর তেল। রাশিয়ার আগ্রাসনের পর এসব পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে বিশ্ববাজারে। কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় প্রধান এই শস্যগুলির দাম বিশ্ববাজারে আকাশ ছুঁয়েছে ইতোমধ্যেই।
এই সঙ্কট নতুন নয়, তবে বেড়েছে
আফ্রিকা মহাদেশসহ বিশ্বের অনেক স্থানে খাদ্য অনিরাপত্তা নতুন নয়। বরং ক্ষুধাই নিত্যদিনের সঙ্গী, তার সঙ্গে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি লেগেই থাকে। মাঝেমধ্যেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় গৃহযুদ্ধ বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এর চেয়েও খারাপ কিছু কি হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা অবশ্য তাই-ই বলছেন। এখান থেকেও পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
জীবনধারণের জন্য খাদ্য সহায়তা না হলেই নয়, ২০১৬ সালের পর থেকে এমন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের যৌথ প্রকল্প ‘গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস।’
সংস্থাটির মতে, দিনে দিনে চ্যালেঞ্জটি বিস্তৃত হচ্ছে। গত বছর এমন খাদ্য সহায়তার একান্ত প্রয়োজন এমন জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি। ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, মাদাগাস্কার ও ইয়েমেনের মতো সংকট কবলিত দেশে এই সংখ্যা ৬ বছর আগের চেয়ে ৫৭১ শতাংশ বেড়েছে। এই বিপুল পরিমাণ মানুষকে খাদ্য সহায়তা না দিলে তাদের জন্য নিশ্চিত মৃত্যু অপেক্ষা করছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব, ইউক্রেন যুদ্ধ আফ্রিকায় অনাহারের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে মারাত্মক ব্যাহত করছে বলেও সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, “এই সংকট মোকাবিলা করতে ইউক্রেনের সরবরাহকে বিশ্ববাজারে আসতে দিতে হবে। একইসাথে, রাশিয়া ও বেলারুশ থেকেও খাদ্য ও সার রপ্তানি নিশ্চিত করতে হবে।”
রাশিয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই দাবি করছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাই বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের জন্ম দিচ্ছে। তবে রাশিয়ার প্রতি ইউক্রেনের আজভ ও কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী বন্দরগুলো থেকে নৌ অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, যাতে অন্তত খরাপীড়িত সাহেল অঞ্চলের জন্য দানাদার শস্য রপ্তানি শুরু করা যায়।
আফ্রিকার বেনিন, নাইজার ও চাদে সফরকালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেছেন, “আমাদের চোখের সামনে এক চূড়ান্ত সংকট ঘটছে। বাড়তি মূল্যের কারণে আমাদের তহবিল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, ক্ষুধাপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার সব সম্ভাবনা মিলিয়ে যাচ্ছে।”
ত্রাণের জন্য খাদ্য কেনার খরচ এখন অনেক বেশি। বাড়তি মূল্যই দিতে বাধ্য হচ্ছে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলো। তাছাড়া, দরিদ্র দেশে মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে জোরেশোরে ঘটছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বাদ পড়েনি উন্নত দেশও। যেমন যুক্তরাজ্যে গড় গৃহস্থালি আয়ের ১০ শতাংশ এখন খাবার কেনার পেছনে খরচ করতে হচ্ছে। কেনিয়া ও পাকিস্তানের মতো দরিদ্র দেশে তা ৪০ শতাংশের বেশি।
ভয়াবহতম খাদ্য সঙ্কটে গোটা বিশ্ব
যুদ্ধের কারণে চলতি বছর ইউক্রেনে গমের উৎপাদন ৩৫ শতাংশ কম হওয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে। তাছাড়া, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার নৌ অবরোধ থাকায় ইউক্রেন নিজেদের উৎপাদিত শস্য রপ্তানিও করতে পারছে না। সব মিলিয়ে গত মার্চেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ইউএন-ফাও) এর নিত্যপণ্য সূচক সকল সময়ের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে যায়। এখনও তা ওই রেকর্ড মাত্রাতেই রয়েছে।
রাশিয়ার শুরু করা যুদ্ধ খাদ্যের আগের ঘাটতিগুলোকেও চরম করে তুলেছে। তীব্র করেছে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি। তার সঙ্গে মহামারির অভিঘাতগুলি যেমন- বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রের সংকট, কর্মসংস্থানের ঘাটতির মতো অন্যান্য অনুঘটক যোগ হয়েছে। জলবায়ু সংকটের ভয়াল পরিণতিও আরেক ত্রাস।
এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মতো প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদনকারী দেশে দাবদাহে ফলন ব্যাহত হয়েছে। জ্বালানির বাজারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এতে বাড়ছে ফসল উৎপাদনের খরচ। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে চলমান যুদ্ধ-সংঘাতও রাখছে মারাত্মক ভূমিকা। সব মিলিয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় এক অন্ধকার সময় দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্রাজিল ও মিশরের মতো মধ্য আয়ের দেশের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলার শক্তি অনেক কম। আন্তর্জাতিক ঝুঁকি পরামর্শক সংস্থা ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফট গত সপ্তাহে প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন এ তথ্য। তারা আরও জানায়, করোনা মহামারি মোকাবিলা করতে করতে- এরমধ্যেই অনেক উন্নয়নশীল দেশের সরকারের বাড়তি আমদানি খরচ বহনের অর্থায়ন ক্ষমতা বহুগুণে কমে গেছে। এজন্য তাদের অনেক ঋণও নিতে হয়েছে।
আর্জেন্টিনা, তিউনিশিয়া, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের মতো খাদ্য ও জ্বালানি আমদানিতে অতি-নির্ভরশীল রাষ্ট্রসহ অন্যান্য মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশে মূল্যস্ফীতির কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকিও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বলে রিপোর্টটি ইঙ্গিত দেয়।
খাদ্য পরিস্থিতির ‘অ্যাপোক্লিপস’ বা অন্ত ডেকে আনা দুর্যোগে সব দেশেই সমাজের সবচেয়ে দরিদ্রদের ভোগান্তি হবে বর্ণানাতীত। এই নিয়তি যেন বার বার তাদের আর্থিক অবস্থাকে আরও শূন্যের কোঠায় ঠেলে দিচ্ছে। সে তুলনায় কিছুটা বিত্তশালীরা হয়তো খাদ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ এড়াতে পারবেন। তবে সে সুরক্ষা একটা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করবে। অর্থাৎ, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের সামনেও ধেয়ে আসছে সংকট কাল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
উন্নয়নশীল দুনিয়ার সামনে যে কালো দিনগুলির পদধ্বনি, তার বাস্তব রূপ দেখতে চাইলে বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের ঘরের কাছেই জ্বলন্ত উদাহরণ দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা। বাজারে খাদ্য নেই; থাকলেও চক্ষুস্থির করা দাম, দিনের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎহীনতা, জ্বালানি, রান্নার গ্যাস ও ওষুধসহ প্রায় সকল নিত্যপণ্যের ঘাটতি লংকাকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে। দিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার আগুনে ঘি। ঠিক এমন চিত্রই অন্যান্য দেশগুলিতে দেখা দিতে পারে।
শ্রীলঙ্কায় কার্যত চলছে প্রেসিডেন্টের শাসন। চলছে সহিংস বিক্ষোভ, নিরাপত্তা বাহিনীও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। অস্থিরতা সমাজের সর্বস্তরকে আক্রান্ত করেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নাকাল এমন দশা। এরমধ্যে গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে জরুরি পণ্য আমদানির বিল মেটাতে যে ঘাটতি রয়েছে- তা পূরণের একটি ঋণ চায় কলম্বো। গত বৃহস্পতিবার দেশটি প্রথমবারের মতো একটি ঋণ পরিশোধেও ব্যর্থ হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার আরেক প্রতিবেশী পাকিস্তানে এখন দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি। এতে সাধারণ খাদ্যপণ্যও চলে গেছে অনেক পাকিস্তানীর নাগালের বাইরে। চড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ে চলতি বছরের শুরুতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল বিরোধী জোট। এখন সেই বিরোধীরাই ক্ষমতায়। তবে ইমরান রাজনীতির ময়দানে সক্রিয়। তার সমর্থকরা এখন নতুন সরকারের বিরুদ্ধেও একই রকম ব্যর্থতার অভিযোগ করছে। ইমরানের পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থন নিয়ে পুরো পাকিস্তানই আজ বিভাজিত। বিপন্ন গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা।
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান- উভয় দেশেই দমনমূলক শাসন, দুর্নীতি, কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা, রাজনৈতিক মেরুকরণের মতো দীর্ঘদিন ধরে চলমান অনুঘটকগুলি রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। তবে মানুষ খাদ্যের অভাব বা নাকাল করে দেওয়ার মতো মূল্যস্ফীতি- কোনো কালেই কোনোদিনই মেনে নেয়নি। পেরু থেকে শুরু করে কিউবা, লেবানন বা তিউনিশিয়ার মতো পৃথিবীর সকল প্রান্তের অজনপ্রিয় সরকারগুলি এবার গণ-অভ্যুত্থানের উৎখাত হওয়ার হুমকিতে রয়েছে।
আরব বসন্তের সময়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রথমে যেভাবে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও তা থেকে ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধ-সংঘাত শুরু হয়েছিল বিশ্লেষকরা তার সঙ্গে বর্তমান ঘটনাবলীর তুলনা করছেন। যেমন ২০১১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম আমদানিকারক মিশরে হোসনি মোবারক সরকার গণ-বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়। ওই সময়েও খাদ্যের মূল্যস্ফীতি মানুষকে রাজপথে নামতে উৎসাহ দিয়েছিল। কারণ মিশরের প্রায় ৭ কোটি মানুষের নিত্যখাদ্য রুটিতে সরকার ভর্তুকি দেয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন- মিশরের ৮০ শতাংশ গম আমদানির চাহিদা মেটায়। যুদ্ধের কারণে আরও একবার সরকার বিরোধী গণ-জোয়ারের আশঙ্কা করছে- বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা স্বৈরশাসক আবদেল ফাতাহ আল-সিসির সরকার।
খাদ্য সংকটে ইরানেও গোলযোগের সম্ভাবনা প্রবল। সরকার রুটি, ভোজ্য তেল ও ডেইরি পণ্যের দাম বাড়ানোর পর গত সপ্তাহে বিক্ষোভ হয়েছে খুজেস্তান প্রদেশে। এমনিতেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সাধারণ ইরানিদের দুর্দশা চরমে, তার ওপর বিশ্ববাজার পরিস্থিতি সরবরাহকে আরও সীমিত করছে। তেহরানের হাতে বিকল্প উপায়ও নেই। ফলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা ২০১৭ ও ১৮ সালের মতো বড় আকারের বিক্ষোভের ধারণা করছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ