মূল্যস্ফীতির প্রেতাত্মা ভর করেছে প্রায় সব দেশেই। বাদ পড়েনি ব্রিটেন। বর্তমানে ব্রিটেনসহ পুরো যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে এত বেশি পণ্যমূল্যের চাপ দেখা গিয়েছিল সেখানে।
বিশ্লেষকের বলছেন, এই মুদ্রাস্ফীতি দেশটির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ জীবনধারণের ক্ষেত্রে সব ধরনের খরচ বাড়াতে পারে।
গত এপ্রিল মাসে দেশটিতে বার্ষিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ৯ শতাংশে। ১৯৮২ সালের পর থেকে এই হার সর্বোচ্চ। একইসঙ্গে আশির দশকের শেষের দিকে ব্রিটেনে সরকারি ভাবে মূল্যস্ফীতির হিসাব রাখা শুরু হওয়ার পর থেকেও এই হার সর্বোচ্চ।
এরমধ্যেই জীবনযাপনের খরচ এতটা বেড়েছে যে গ্যাস/বিদ্যুৎ বিল বাঁচাতে ঘর উষ্ণ রাখার হিটিং সিস্টেম পারতপক্ষে বন্ধ রাখছেন প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন ব্রিটিশ। গাড়ি চালানো কমিয়েছেন ৫০ শতাংশ এবং প্রতি ২৫ শতাংশ কোনো কোনো বেলা না খেয়ে খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন।
নিম্ন আয়ের নাগরিকদের এক-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে তারা কোনো কোনো বেলার খাবার খেতে পারেননি। মঙ্গলবার (১৭ মে) জরিপ সংস্থা ইপসোসের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে দেশটিতে উদ্বেগ এখন গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। জরিপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ ব্রিটিশ আগামী ছয় মাসে নিত্যপণ্যের মূল্য আরও চড়া হওয়ার শঙ্কা ব্যক্ত করেন।
ইপসোসের রাজনৈতিক গবেষণা বিষয়ক প্রধান গিডন স্কিনার বলেন, “অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের ভিত্তিতে আগামী দিনগুলোয় আরও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তা হয়তো বলাই যায়। এতে মানুষের জীবনযাপনে উচ্চ ব্যয়ের সংকট দূর করতে সরকারের ওপর আরও বেশি পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ বাড়বে।”
এদিকে আজ বুধবার (১৮ মে) মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস। এতে জানানো হয়, এপ্রিল পর্যন্ত চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ শতাংশ, ১৯৮২ সালের মার্চের পর যা সবচেয়ে দ্রুতগতির।
এর আগে জ্বালানির দাম বাড়ায় গত মার্চে মূল্যস্ফীতি হয় ৭ শতাংশ। কিন্তু, তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে পাইকারি বাজারের পণ্যমূল্য। এপ্রিলে সেকারণে ভোক্তাদের খরচের বিলে ৫৪ শতাংশের মতো বিশাল উত্থান দেখা গেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির বিশ্ববাজার এখন চরম অস্থিতিশীল। এপ্রিলে যুক্তরাজ্যে পেট্রোল ও ডিজেলের রেকর্ড মূল্যে তার প্রতিফলনই দেখা গেছে।
আরও শোচনীয় পরিস্থিতির শঙ্কা করছে ব্যাংক অভ ইংল্যান্ড। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি ধারণা করছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মূল্যস্ফীতি সামলাতে সরকারের ওপর চাপ বাড়লেও, এখনই আরও সহায়তা বাড়াতে চাইছেন না অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক। শরৎকালে গৃহস্থালি পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিল আরেকদফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, এরপর পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তবে সরকারের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয় জনতা। ইউগভের একটি জরিপে অংশ নেওয়া ৭২ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের মতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় বাজে পারফর্ম করেছে। আগের বছরের তুলনায় এবার এমন মতপ্রকাশকারীদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
অবশ্য কেবল যুক্তরাজ্যই নয়, গোটা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। গত একমাস ধরে কার্যত ধুঁকছে শ্রীলঙ্কা। হাঙ্গেরি জ্বালানি এবং খাবারের দাম ফ্রিজ করে দিয়েছে। জাপানে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আফ্রিকায় খাদ্য সংকট শুরু হয়েছে, যা সামাজিক লড়াইয়ে রূপ নিতে পারে। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বজুড়েই এক অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ সেই অবস্থায় আরও ইন্ধন দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে গত মার্চ মাসে আরেক ইউরোপীয় দেশ জার্মানির মুদ্রাস্ফীতি সাত দশমিক তিন শতাংশে পৌঁছায়। এরপর এপ্রিল মাসে তা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৮১ সালে পশ্চিম জার্মানি শেষ এমন দ্রুত মুদ্রাস্ফীতি দেখেছিল। অর্থাৎ এই মুদ্রাস্ফীতি গত চার দশকে ঘটেনি।
মূলত তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই এই হারে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ ইউরোপের অনেক দেশ তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই সেসব দেশের জ্বালানিখাতে ব্যয় বাড়তে থাকে। আর তারই প্রতিফলন ঘটছে সার্বিক অর্থনীতিতে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫৮
আপনার মতামত জানানঃ