আফগানিস্তানের মানবাধিকার কমিশনসহ দেশটির সাবেক মার্কিন-সমর্থিত সরকারের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বিলুপ্ত করেছে ক্ষমতাসীন তালিবান। গতকাল সোমবার তালিবান সরকারের এক কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন। খবর রয়টার্সের।
অপর যে চারটি বিভাগ তালিবান বিলুপ্ত করেছে, তার মধ্যে হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন (এইচসিএনআর), একসময়ের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, আফগান সংবিধান বাস্তবায়নের তত্ত্বাবধান কমিশন রয়েছে।
এইচসিএনআর সবশেষ সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল। সংস্থাটি তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার ও তালিবানের মধ্যে শান্তি আলোচনার জন্য কাজ করছিল। তালিবানের দখল অভিযানের মুখে গত বছরের আগস্টে আশরাফ গনির সরকারের পতন ঘটে।
আর্থিক সংকটের মুখে পাঁচটি বিভাগকে তালিবান অপ্রয়োজনীয় মনে করায় তারা তা বিলুপ্ত করেছে।
এ প্রসঙ্গে তালিবান সরকারের উপমুখপাত্র ইন্নামুল্লা সামাঙ্গানি রয়টার্সকে বলেন, এই বিভাগগুলোকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়নি। তাই বিভাগগুলোকে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিভাগগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান। দেশটির ক্ষমতা দখলের পর গত শনিবার তালিবান প্রথম বার্ষিক জাতীয় বাজেট ঘোষণা করে। এই বাজেটে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতির পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন আফগানিস।
তালিবান সরকারের উপমুখপাত্র ইন্নামুল্লা সামাঙ্গানি রয়টার্সকে বলেন, বস্তুগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় বাজেট দেওয়া হয়েছে। এই বাজেট দেওয়া হয়েছে শুধু সক্রিয় ও উৎপাদনশীল বিভাগগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে।
এই বিভাগগুলোকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়নি। তাই বিভাগগুলোকে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিভাগগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে।
যে বিভাগগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে, ভবিষ্যতে যদি সেগুলোর প্রয়োজন হয়, তাহলে তা আবার সক্রিয় করা হতে পারে বলে জানান তালিবান সরকারের উপমুখপাত্র।
তালিবান প্রথম দফায় ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল। সে সময় কট্টর শাসনব্যবস্থার কারণে তালিবান কুখ্যাতি কুড়ায়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। এর জেরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালায়। হামলার মাধ্যমে আফগানিস্তানের তখনকার তালিবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তৎকালীন তালিবান সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালিয়েছিল। পরে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রায় ২০ বছর ধরে যুদ্ধ চালানোর পর গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তান ত্যাগ করে মার্কিন বাহিনী। বিদেশি বাহিনীর আফগানিস্তান ত্যাগের মধ্যেই দেশটির ক্ষমতা দখল করে তালিবান।
ক্ষমতা দখলের পর তালিবান বিশ্বকে আশ্বস্ত করেছিল যে এবার তারা নমনীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করবে। কিন্তু নারী, মানবাধিকারসহ নানা ইস্যুতে তালিবানকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে।
তালিবান সরকার সম্প্রতি নারীদের বাইরে যেতে পুরো শরীর বোরকায় ঢাকা বাধ্যতামূলক করে আদেশ জারি করে।
আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ নেতা ও তালিবানপ্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার জারি করা আদেশে বলা হয়, নারীদের উচিত মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ঢেকে থাকা বোরকা পরা। নারীদের বাইরে যদি জরুরি কাজ না থাকে তবে বাড়িতে অবস্থান করাই ভালো।
নারী আন্দোলনকারী গুম
আফগানিস্তান দখলের পর থেকে তালিবানরা ক্ষমা প্রার্থনা করে নানারকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের শাসন প্রক্রিয়ায় কট্টরপন্থী আফগান নাগরিকরা অতিষ্ট হয়ে আছেন। বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তালিবান তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।
তাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক লোকজনদের রাস্তাঘাটে হত্যা, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা এবং মুখ খোলার জন্য নারীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান। এরপর থেকেই তারা নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে। নারীদের পুরুষ সঙ্গী ছাড়া দূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে নিষেধ করা হয়েছে, গাড়িচালকদের আহ্বান জানানো হয়েছে বোরকা ছাড়া গণপরিবহনে উঠতে না দিতে।
এমতাবস্থায় দেশটির নারীরাও বসে নেই। তারাও তালিবান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে।
এদিকে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার তামানা পারিয়ানি, পারায়ান ইব্রাহিমখেল ছাড়াও আরও কয়েকজন নারী কর্মী আফগানিস্তানে নিখোঁজ হয়েছেন।
গত ১৬ জানুয়ারি, পারিয়ানি ও ইব্রাহিমখেল কাবুলে তালিবানবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর ঠিক ২ দিন পরই ১৯ জানুয়ারি, সশস্ত্র কিছু ব্যক্তি নিজেকে তালিবান গোয়েন্দা বলে পরিচয় দিয়ে দরজা ভেঙে ৩ বোনসহ পারিয়ানিকে ধরে নিয়ে যায়। সশস্ত্র ব্যক্তি বাড়িতে ঢোকার আগ মুহূর্তের একটি ভিডিও পোস্ট করেন পারিয়ানি।
ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ইব্রাহিমখেলের ক্ষেত্রে। তাদের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
ক্ষমতায় আসার পর তালিবান দেশটির নারীদের কাজ ও পড়াশোনার অধিকারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। দেশের বেশির ভাগ অংশে নারীদের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। শান্তিপূর্ণ নারী বিক্ষোভকারীদের মারধর, পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করেছে।
এমনকি এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের স্বাভাবিক কার্যক্রম সীমিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের আটক ও মারধর ছাড়াও আগের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গুম করার অভিযোগ আসছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
সেনা ও পুলিশ সদস্য হত্যা
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মধ্য আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
যদিও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির সাবেক নিরাপত্তা বাহিনীর শতাধিক সদস্যকে হত্যা অথবা গুম করেছে।
সংস্থাটি বলেছে, তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও স্থানীয় তালিবান কমান্ডাররা সাবেক ওইসব সেনা ও পুলিশ সদস্যকে হত্যার নিশানা করেছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, তালিবান ক্ষমতা নেওয়ার পর আদেশ দিয়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধন করুন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে চিঠি দেওয়া হচ্ছে, তা সংগ্রহ করুন। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধনের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অনেকে সেখানে গুম হয়েছেন বা তাদের হত্যা করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তালিবান তাদের পূর্ববর্তী সরকারের বিভিন্ন নথি ধরে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের খুঁজে বের করে হত্যা অথবা গুম করেছে।
‘শক্তিশালী সেনাবাহিনী’
দেশের ভূখণ্ড রক্ষা ও সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়াতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে আফগানিস্তান। ইতোমধ্যে কাজও শুরু হয়ে গেছে। ইসলামিক আমিরাতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানায়। খবর টোলো নিউজের।
বিবৃতিতে বলা হয়, এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি সেনা ইতোমধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দেশটির লক্ষ্য, এক লাখ ৫০ হাজারের মতো সেনা নিয়োগ দেওয়া।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইনায়েতুল্লাহ খাওয়ারজামী বলেন, এক লাখ ৩০ হাজারের মতো সেনা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে আফগানিস্তান একটি স্বাধীন, সুগঠিত এবং নিবেদিত সেনাবাহিনী দেখতে পাবে যারা দেশ রক্ষার পাশাপাশি সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
খাওয়ারজামী বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক নারী কর্মীরা এখনও বেতন পাচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে কিছু এখনও মন্ত্রণালয়ে কাজ করছেন।
অভিজ্ঞদের পরামর্শ হলো— পেশাদার ও অভিজ্ঞদের যেন সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়। সামরিক বিষয়ে অভিজ্ঞ আসাদুল্লাহ নাদিম বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—শিক্ষা, পেশাদারী প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা, সরঞ্জাম এবং বাজেট।
সামার সাদাত নামের অপর একজন বলেন, একটি নিরপেক্ষ, আন্তরিক, পেশাদার এবং স্বাধীন সেনাবাহিনী গঠন করা উচিত।
সাবেক সরকারের আফগান ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্সের (এএনডিএসএফ) সদস্য ছিল সাড়ে তিন লাখের বেশি। এএনডিএসএফ ভেঙে পড়ার পর বহু সেনা সদস্য বর্তমানে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ