বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগী আদিত্যনাথের প্রথম কার্যকালের সময়, বুলডোজারগুলি ব্যাপকভাবে তথাকথিত ‘অবৈধ’ বাড়ি এবং ব্যবসা গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। আদিত্যনাথ দ্রুত বিখ্যাত হন “বুলডোজার বাবা” নামে।
এই বছর মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাটে তার প্রতিপক্ষরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যখন এই রাজ্যগুলিতে একই রকম ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। ২০ এপ্রিল জাহাঙ্গীরপুরীতে ধ্বংস অভিযান, যেসময় একটি মসজিদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
নতুন দিল্লির জাহাঙ্গীর পুরীতে এক সকালে বাসিন্দারা তাদের দোকান এবং স্টল ধ্বংসকারী বুলডোজারের শব্দে জেগে উঠেছিল। ২৪ বছর বয়সী বাসিন্দা সাবিনা বিবি তার বাড়ির কাছে একটি বুলডোজার দেখতে পেয়ে তার ধ্বংসযজ্ঞ কেমন ছিল তা পরীক্ষা করতে বেরিয়েছিলেন। দেখেন তার পান এবং সিগারেট বিক্রির ছোট স্টলটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। আয়ের একমাত্র উৎস শেষ হয়ে গেছে।
সাবিনা বলেন, দোকান ভেঙ্গে ফেলার আগে অন্তত আমাদের জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য সতর্ক করার দরকার ছিল, যা হয়নি। কোনো পূর্ব বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়নি। বিজেপি তাই অনেকের মতে ‘বুলডোজারের রাজনীতি’ বা ‘বুলডোজার রাজ’ হিসাবে সমালোচিত। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় দোকান এবং বাড়িতে বুলডোজারের ব্যবহার এখন সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রকাশ্য বৈষম্যের প্রতীক হয়ে উঠছে।
সুপ্রিমকোর্টের স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও প্রায় তিনঘন্টা ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত ছিল। হিন্দু দেবতা হনুমানের জন্ম উদযাপন, হনুমান জয়ন্তী সমাবেশের সময় ১৬ এপ্রিল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ফলে যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তা অনেক পরিবারকে আয়হীন বেকারে পরিণত করে।
১২ এপ্রিল হিন্দু দেবতা রামের জন্ম উদযাপনে রাম নবমী সমাবেশে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয় তার দুদিন পরে, মধ্যপ্রদেশের খারগোন অঞ্চলে একটি ধ্বংস অভিযান চালানো হয়েছিল। গত মঙ্গলবার নাগরিক কর্তৃপক্ষ আবার গুজরাটের হিম্মতনগর শহরে একটি ধ্বংস অভিযান শুরু করেছে, যেখানে এই মাসের শুরুতে রাম নবমী উদযাপনের সময় একটি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হয়।
এর আগে রাম নবমী উদযাপনের সময় খম্ভত শহরে সহিংসতার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মালিকানাধীন বিল্ডিং অপসারণের জন্য প্রশাসন বুলডোজার ব্যবহার করে বিল্ডিং ভাঙ্গার অভিযান চালিয়েছিল। তিনঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরপুরী এবং গুজরাটের বেশ কয়েকটি দোকান বুলডোজার দ্বারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা এখন ভিক্ষা করছে।
এর আগে খারগোনে, প্রশাসন প্রায় ১৬টি বাড়ি এবং ২৯টি দোকান ভেঙে দিয়েছে। ২৪ শে এপ্রিল, আম আদমি পার্টি (এএপি) বিজেপির “বুলডোজার রাজনীতির” বিরুদ্ধে নয়াদিল্লিতে পদযাত্রা করেছে এবং জনগণকে বিজেপির “গুন্ডামী এবং দুর্নীতি” থেকে “ভীতি ও হুমকি” না পেতে বলেছে।
১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইফতারের প্রায় দশ মিনিট বাকি ছিল, যখন জাহাঙ্গীরপুরীর একটি মসজিদে হিন্দু জনতা হামলা চালায়। তারা জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছিল। তারা মসজিদের দেয়াল ও জানালা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে জানান সাবিনা।
সাবিনা বলেন, মুসলিম বাসিন্দারা মসজিদের ক্ষতি সাধন থেকে জনতাকে বাধা দিতে বের হলে নারী-পুরুষকে বেদম মারধর করা হয়। এমন কি কর্তৃপক্ষও তাদের সঙ্গে আছে। তখন অন্তত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের বেশির ভাগই মুসলিম পুরুষ।
পরে বিজেপি সহিংসতায় “অবৈধ অভিবাসীদের” ভূমিকার তদন্তের দাবি করে অভিযোগ করে যে, বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা মুসলিম অভিবাসীরা সহিংসতা শুরু করেছিল।
সাবিনা বলেন, আমার স্বামী ভয় পেয়ে সেদিন পালিয়ে গিয়েছিল। আমি জানি না তিনি কোথায় আছেন। পুলিশ তাদের কোন দোষ ছাড়াই পুরুষদের গ্রেফতার করেছে, বলেও জানান সাবিনা। সাবিনার প্রশ্ন, একজন মুসলিমকে কেন প্রতিরোধ করা উচিত? এমনকি আমাদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হলেও, আমাদের জবাবে একটি শব্দও বলা উচিত নয় কেন? আক্রমণ শেষ হওয়ার পরে, আসন্ন ধ্বংসের গুজব ছড়াতে শুরু করে তারা।
বাড়ির বাইরে খাবারের স্টল থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টাকা আয় করেন সাবিনা। সাবিনা বলেন, ব্যবসা করে যা আয় করতাম, তা দিয়ে আমার দুই মেয়েকে খাওয়াতাম। এখন আমরা কেউ আমাদের খাবার দেবে, সেজন্য অপেক্ষা করছি। তিনি বলেন, ভাঙার সময় তার বাড়ির দেয়াল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভারতীয় মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম সামাজিক-ধর্মীয় সংগঠন জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দ বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ধ্বংসের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছে।
জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দের সেক্রেটারি নিয়াজ ফারুকি মকতুবকে বলেছেন যে, সংগঠনটি সুপ্রিম কোর্টে চলে গেছে। কারণ, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ধ্বংস করা হয়নি। মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে ভাঙা শুরু করার আগে তাদের অন্তত জনগণকে নোটিশ পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ