নরখাদকের কথা উঠলেই অজান্তেই নজর চলে যায় আফ্রিকার মানচিত্রের দিকে। কিংবা মনে হতে পারে কাপালিক বা অঘোরপন্থীদের কথাও। তবে নরখাদকের কথা উঠলে ভুলেও কেউ ইউরোপের কথা মনেই আনেন না। বিশ্ব মানচিত্রের উত্তরের দিকে, ইউরোপের পানে নজরই দেন না। ইউরোপের সাথে নরখাদকের দূরতম সম্পর্কের কথাও অনেকেই কল্পনা করতে পারেন না।
কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হলো, ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতেও মানুষের মৃতদেহ খাওয়ার চল ছিল ইউরোপে। শবের ভেষজগুণ আছে, আছে রোগ সারিয়ে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতা, এমন এক বিবেচনা থেকে মৃতদেহের মাংস, করোটি, হাড় প্রভৃতি খাওয়া হতো।
এ ভাবে নরখাদকের গড্ডলে যারা গা ভাসিয়ে ছিলেন সে দলে বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে যাজক পর্যন্ত সব শ্রেণির ইউরোপীয় মানুষের দেখা মিলবে। সপ্তদশ শতকের মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের অগ্রদূত টমাস উইলিস অ্যাপোলেক্সি বা মস্তিষ্কে রক্তপাত বন্ধে একটি পানীয় তৈরি করেন। এর উপাদান ছিল মানুষের মাথার খুলি এবং চকোলেট।
ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস “দ্য কিংস ড্রপস” নামের নিজস্ব আরক পান করতেন। এতে মদে চুবানো মানুষের মাথার খুলি থাকত। এমনকি মাটি চাপা মাথার খুলিতে গজাত টুপির মতো শ্যাওলার আস্তরও ব্যবহার হতো অসুখ সারাতে। ইউসেনা নামে পরিচিত এই আস্তরকে মূল্যবান ভেষজগুণ সম্পন্ন বলে মনে করা হতো। নাকের রক্ত-ক্ষরণ এবং মৃগীরোগ নিরাময় করে বলেও সে সময়ে মানা হতো।
মানুষের চর্বি শরীরের বাইরের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হতো। যেমন, জার্মান চিকিত্সকরা ক্ষত চিকিৎসায় চর্বিমাখা ব্যান্ডেজ লাগানোর ব্যবস্থাপত্র দিতেন। গেটে বাতের প্রতিকার হিসেবে ত্বকে চর্বি ঘষারও ব্যবস্থাপত্র সে যুগের জার্মানিতে দেওয়া হতো। আর এ সবই ছিল মানুষের চর্বি।
রক্তকে যতদূর সম্ভব তাজাই সংগ্রহ করা হতো এবং রক্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর বলেই বিশ্বাস করা হতো। ষোড়শ শতকের জার্মান-সুইস চিকিৎসক প্যারাসেলসাস বিশ্বাস করতেন যে রক্ত অনবদ্য পানীয়। এমনকি তার এক অনুসারী জীবিত দেহ থেকে রক্ত যোগাড়ের পরামর্শও দিয়েছেন। তবে এ ভাবে তাজা রক্ত পানের চল হয়ত তেমন বেশি ছিল না।
গরিবের পক্ষে ভেষজ দোকান থেকে দামি ওষুধ কেনা সম্ভব ছিল না। তবে তারাও নরদেহজাত কথিত ওষুধ সেবনের সুযোগ পেতো। মৃত্যুদণ্ডের পর দণ্ডিতের দেহের গরম রক্ত অল্প মাত্রা পান করার সুযোগ তাদের জন্য আসত। এ সুযোগ মাগনা ছিল না। বরং এ জন্য দিতে হতো সামান্য পরিমাণ অর্থ।
১৬৭৯ সালে খ্রিস্টান রোমান ক্যাথলিকদের একটি গোষ্ঠী, ফ্রান্সিসকান, রক্ত দিয়ে মোরব্বা জাতীয় খাবার তৈরির রন্ধন প্রণালী প্রকাশ করেন। ভক্তদের মধ্যে যারা রক্তে তৈরি খাবার খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্যেই এটি প্রকাশ করা হয়।
মানুষের দেহাবশেষকে শক্তিআধার হিসেবে ধরে নেওয়ার আরেকটি কারণ ছিল। যে দেহ থেকে এই দেহাংশ যোগাড় করা হয়েছে তাতে সে দেহের আত্মাও রয়েছে বলেই মনে করা হতো। আত্মাকে শরীরের বাস্তব অংশ বলেই ধরা হতো। এ ভাবেই দেহ ও আত্মার সম্পর্কের কথা এসেছে। এ ক্ষেত্রে রক্ত বিশেষভাবে শক্তিশালী ভূমিকায় রয়েছে বলেও ধরে নেওয়া হতো।
এমন ভাবনা রেনেসাঁ যুগের জন্যও নতুন নয় কেবল নতুন করে জনপ্রিয় হয়েছে। রোমানদের মধ্যে নিহত গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত পানের চল ছিল। শক্তিশালী যুবকটির জীবনীশক্তি হাতিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এ কাজটি করা হতো। পঞ্চদশ শতাব্দীর দার্শনিক মার্সিলিও ফিসিনো একই লক্ষ্য অর্জনে তরুণের হাত কেটে রক্ত পান করার পরামর্শ দেন। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং ভারত সহ অন্যান্য সংস্কৃতির অনেক চিকিৎসক বা বৈদ্য বিশ্বাস করতেন রোগ নিরাময়ে বা শক্তি অর্জনে মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপযোগিতা রয়েছে ।
বিজ্ঞান এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসায় নরখাদক প্রবণতাগুলো বিদায় নিতে থাকে। ১৮ শতকে ইউরোপীয়রা নিয়মিতভাবে খাওয়ার ক্ষেত্রে কাঁটাচামচ এবং গোসলের জন্য সাবান ব্যবহার করতে শুরু করলে এই অভ্যাসটি খুব কমে যায়। মৃতদেহকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারে প্রবণতা কমলেও একদম বিদায় নেইনি তখনও।
১৮৪৭ সালে এক ইংরেজকে পরামর্শ দেওয়া হয়, তরুণীর মাথার খুলির সাথে ঝোলা গুড় মিশিয়ে খাওয়ালে তার মেয়ের মৃগীরোগ সেরে যাবে। ভদ্রলোক কথিত ভেষজটি যোগাড় করতে এবং আত্মজাকে খাওয়াতেও পেরেছিলেন। যদিও রোগের ওপর এর কোনও প্রভাবই পড়েনি।
এদিকে ‘জাদুর মোমবাতি’ নিয়ে একটি বিশ্বাস ১৮৮০’এর দশক পর্যন্ত বজায় ছিল। মানুষের চর্বি দিয়ে বানানো এমন মোমবাতিকে “চোরের মোমবাতি” বলা হতো। এ দিয়ে যে কাউকে হতবুদ্ধি এবং পঙ্গু করে দেওয়া যেত বলে বিশ্বাস করা হতো। ২০ শতকের শুরুতে একটি জার্মান চিকিৎসা ক্যাটালগে মমিকে ওষুধ হিসেবে বিক্রির জন্য তালিকাভুক্তি করা হয়। ১৯০৮ সালে জার্মানিতে ফাঁসির পর মৃত আসামির রক্ত পান করার সর্বশেষ ঘটনা ঘটে।
তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মানবদেহ ব্যবহারের চল রয়েছে, সে কথা হয়ত অনেকেই ভুলেই যাই। রক্ত সঞ্চালন, অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং ত্বক যোজনা হলো মানব শরীরকেই চিকিৎসার কাজে বা রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহারের উদাহরণ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ