আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কিনা সেই নিশ্চয়তার আগেই দল ভাঙার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক দলের হাইকমান্ডের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তে এ অবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যদিও এই ভাঙনের সুর উঠেছিল গত সংসদ নির্বাচন থেকেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক-ভাবেই বিএনপি’র কৌশলে ভুল ছিল বলে মনে করেন দলটির অধিকাংশ নেতা-কর্মী।
মূলত শুরু থেকে বিএনপি বা জোটের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করবে, কিভাবে সরকার গঠন করবে,কে মূখ্য নেতৃত্বে থাকবেন; তা ছিল ধোঁয়াশার মতো।
বিএনপির নেতারা অনেকটা হাত-পা ছেড়ে বসেছিলেন। তারা পুরো নির্ভরতা ছেড়ে দেন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের ওপর।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির নেতারা জানান, ড. কামাল ও ফখরুলসহ দলের অনেক সিনিয়র নেতাদের ভুল কৌশলের কারণে নির্বাচনে এমন ভরাডুবি হয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও মূল্যায়ন করা হয়নি বলে জানান তারা।
২০১৪ সালে প্রথমবার ভাঙনের মুখে পড়ে এই জোট। এরপর ১৬, ১৮, ১৯ ও ২০২১ সালে দুবার—সব মিলিয়ে ছয় দফা ভাঙন হয় বিএনপি জোটে। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জোটে ভাঙন হলেও ছেড়ে যাওয়া দলগুলোর মূল অভিযোগ বিএনপির ওপর।
দলগুলোর দাবি, ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে রেখেছে বিএনপি। একইসঙ্গে ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর ২০ দলীয় জোটকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এ ক্ষোভই শরিকদের জোট ত্যাগের বিষয়টি ত্বরান্বিত করেছে।
সম্প্রতি দল ভাঙার শঙ্কা দেখায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা আস্থাভাজন কয়েকজন নেতাকে নজরদারি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের কে কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন, কোন প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছেন;সবই পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলের বেশ কিছু নেতা নির্বাচনমুখী হতে পারেন। গত দুই বছরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে নানা কারণে দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা পদাবনতি করা হয়েছে, সেই নেতাদের ঘিরে বিএনপিতে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করায় চলতি মাসের ৫ এপ্রিল শওকত মাহমুদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে দল।
এ বিষয়ে শওকত মাহমুদ বলেন, দল আমার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। আমি সেই চিঠির ব্যাখ্যা দিয়েছি। অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করায় শওকত মাহমুদকে বেশ কয়েকবার শোকজ করা হয়। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বরও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৈমুর আলম খন্দকারকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদ থেকে সরিয়ে আরেকজন নেতাকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তৈমুর আলমকে।
নির্বাচনের পর ১৮ জানুয়ারি দলের প্রাথমিক সদস্যপদও হারান তিনি। তবে তৈমুর আলম খন্দকার জানিয়েছেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে তিনি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন।
নির্বাচনের আগে যাদের ঘিরে সন্দেহ বিএনপির, তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর বিএনপির কমিটি থেকে মঞ্জু ও তার অনুসারীরা বাদ পড়লে সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তাকে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি।
গত ৫ এপ্রিল বিএনপি জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে নির্বাহী সদস্য করা হয়। তাকে নিয়েও দলের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা রয়েছে।
বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে এহসানুল হক মিলনের পদাবনতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন প্রভাবশালী কিছু নেতা।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পদ হারিয়েছেন। এছাড়া আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দলটি।
বিএনপি যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে দল ভাঙার শঙ্কা থেকেই যায়। কারণ, পদ হারানো নেতাদের সঙ্গে বিএনপির একটি অংশ স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ