আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরপর তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৬ জন এবং আহত হয়েছেন বহু জন।
মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) পশ্চিম কাবুলে এ ঘটনা ঘটে। আফগান নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্স বলছে, হামলা হওয়া এলাকার পাশেই সংখ্যালঘু শিয়া জনগোষ্ঠী হাজারা সম্প্রদায়ের বহু মানুষ বসবাস করেন।
কাবুলের কমান্ডারের মুখপাত্র খালিদ জাদরান বলেছেন, একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনটি বিস্ফোরণ ঘটেছে, আমাদের শিয়া জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ হতাহত হয়েছেন।
আফগান নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, মঙ্গলবার পশ্চিম কাবুলের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনটি বিস্ফোরণ হয়। কাবুলের দাস্তে বারচি এলাকায় আবদুল রহিম শহিদ হাইস্কুল চত্বরে এই বিস্ফোরণটি ঘটে।
জানা গিয়েছে, যে আবদুল রহিম শহিদ হাইস্কুলে পরপর বিস্ফোরণ ঘটে সেটি সংখ্যালঘু শিয়া হাজারা অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত। ইসলামিক স্টেটের মতো সুন্নি কট্টরপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলি বারবার এই সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালায় আফগানিস্তানে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের নার্সিং বিভাগের প্রধান বলেন, বিস্ফোরণে অন্তত চারজন নিহত ও ১৪ জন জখম হয়েছেন।
পরে আফগানিস্তান রাইটস ওয়াচের তরফে জানাবো হয়, ৮ পড়ুয়াসহ অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এই বিস্ফোরণে। তবে শেষ পাওয়া খবর পর্যন্ত আফগানিস্তানের টোলো নিউজের তরফে দাবি করা হয়েছে যে ঘটনায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে পৃথক এক প্রতিবেদনে ভারতীয় বার্তাসংস্থা এএনআই জানিয়েছে, পশ্চিম কাবুলের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে দু’টি বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত হয়েছেন। রুশ বার্তাসংস্থা স্পুটনিক নিউজের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিস্ফোরণের এই ঘটনায় আরও কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন।
বার্তাসংস্থাটি জানিয়েছে, কাবুলের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মুমতাজ স্কুলে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। পরে রাজধানী কাবুলের দাশত-ই-বারচি জেলায় আরেকটি স্কুলের কাছে দ্বিতীয় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ওই সূত্রটি জানিয়েছে, বিস্ফোরণের ঘটনায় ৬ জন নিহত এবং আরও কয়েক ডজন আহত হয়েছেন।’
যে আবদুল রহিম শহিদ হাইস্কুলে পরপর বিস্ফোরণ ঘটে সেটি সংখ্যালঘু শিয়া হাজারা অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত। ইসলামিক স্টেটের মতো সুন্নি কট্টরপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলি বারবার এই সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালায় আফগানিস্তানে।
তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা ছিল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়!
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
বেসামরিক সরকার হাজারাদের কথা শোনার চেষ্টা করলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে জঙ্গিদের কিলিং মিশনের টার্গেটে পরিণত হয় হাজারারা। তালিবান থেকে শুরু করে যেকোনো সুন্নি উগ্রবাদীরা হাজারাদের মুসলমান মনে করে না।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তালিবান কমান্ডার মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ সমবেত সুন্নি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘হাজারারা মুসলিম নয়, তাদের হত্যা কর।’ এরপর তাদের ওপর চরম নিপীড়ন চলতে থাকে। তালিবান সরকারের সময় হাজারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হত্যা-নির্যাতনের ভয়ে অনেক হাজারা শিয়াপ্রধান দেশ ইরানে পালিয়ে যায়। আর যারা মাটির মায়া ছাড়তে না পেরে থেকে যায়, তাদের ভাগ্যে জোটে নির্মম অত্যাচার। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই শরিফে ষড়যন্ত্র করে কয়েক হাজার হাজারাকে হত্যা করা হয়। তালিবান ও আল-কায়েদার জঙ্গিরা সুযোগ পেলে হাজারাদের রক্তে হাত রাঙাতে দ্বিধা করে না।
বর্তমানে হাজারাদের নতুন শত্রু আইএস। পথে, বাসে, প্রতিষ্ঠানে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে হামলা চালাচ্ছে তারা। চারদিক থেকে নির্যাতনের শিকার হাজারা সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হামলা তালিবান সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। বিদেশী বাহিনী চলে যাওয়ার পর গত আগস্টেই তারা ক্ষমতা বুঝে নেয়। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তালিবান সরকার-সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বেশ কয়েকজন আইএস নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো অনেক সন্দেহভাজনকে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এখনো প্রকাশ্যে কোনো অভিযোগ করা হচ্ছে না।
তালিবানরা এবার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আগের চেয়ে শান্ত হবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন অনেক আফগান নাগরিক। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তালিবান সরকারের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান বা আইএস-কে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪২
আপনার মতামত জানানঃ