৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের দানবাকৃতির গাড়ি। শুনতে যতটা বিস্ময়কর, দেখতে ততটাই হতবাক করার মতো ছিল সেই গাড়ি। স্টুডবেকার কোম্পানির নির্মিত বিশাল এ গাড়িটি অবশ্য চালিয়ে বেড়ানোর মতো কোনো বাহন ছিল না। একে বরং বলা যেতে পারে আসল গাড়ির বিশালাকারের রেপ্লিকা বা মডেল।
নিজেদের নির্মিত প্রেসিডেন্ট ফোর সিজন রোডস্টার গাড়ির আদলে এই দানবীয় গাড়িটি তৈরি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে বড় আকারের গাড়ি তৈরি করে সবাইকে চমকে দেয়ার এই কাজ একবার নয়, বরং দুবার করে স্টুডবেকার।
৪০ ফুটের এ গাড়ি ছাড়াও ৮০ ফুট আকারের অস্থায়ী আরেকটি গাড়ির মডেলও তারা নির্মাণ করে বিশ্বমেলায় প্রদর্শনীর জন্য। বিস্ময়কর এসব গাড়ির মডেল তৈরি করে নিজেদের ইতহাসের পাতায় স্থায়ী করে রাখা স্টুডবেকার কোম্পানির যাত্রা শুরু ১৮৫২ সালে।
সাউথ বেন্ডে কামারের দোকান খোলার মধ্য দিয়ে তাদের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হয়। হেনরি এবং ক্লিমেন্ট স্টুডবেকার ভাইদের দোকানে সে যুগে তৈরি হতো ঘোড়ায় টানা গাড়ি এবং ওয়াগন।
সময় পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে স্টুডবেকার কোম্পানি গৃহযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে ইউএস আর্মির জন্য নানা ধরনের সামরিক যান নির্মাণ করে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৯১৮ সালে তাদের নির্মিত ট্যাঙ্ককে একেবারে প্রথমদিককার নির্মিত ট্যাঙ্কের একটি বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
এর বাইরেও প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য ট্রাক এবং বোমারু বিমানের জন্য ইঞ্জিন নির্মাণে সম্পৃক্ত ছিল তারা।
সামরিক যানবাহন নির্মাণে দক্ষ হলেও সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্যও নানা ধরনের গাড়ি নির্মাণ করতো স্টুডবেকার। আর গাড়ি নির্মাণ এবং পরীক্ষার জন্য ১৯২৬ সালে প্রায় এক মিলিয়ন ডলার খরচ করে তারা একটি কারখানা এবং বিশাল এক গাড়ি পরীক্ষাকেন্দ্র নির্মাণ করে।
এই পরীক্ষাকেন্দ্রে ডিম্বাকৃতির ৩ মাইল ট্র্যাক ছাড়াও ছিল কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করা নানা ধরনের পরিবেশ, যেখানে নতুন উদ্ভাবিত গাড়িগুলোকে চালিয়ে সেটার ক্ষমতা নিশ্চিত করা যেত।
১৯৩১ সালে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে নাস্তানাবুদ বাজারকে চাঙ্গা করতে অভিনব এক বিজ্ঞাপন প্রকল্প হিসেবে ৪০ ফুটের সুবিশাল মডেল গাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয় স্টুডবেকার কোম্পানি। ১৯২৬ সালের প্রেসিডেন্ট ফোর সিজন রোডস্টার গাড়ির আদলে বিশাল গাড়িটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
আসল গাড়ির প্রায় আড়াই গুণ আকারের এই মডেলের দৈর্ঘ্য ছিল ৪০ ফুট এবং উচ্চতা ১৪ ফুট। হোয়াইট পাইন কাঠের তৈরি গাড়ির বডিটি দেখতে অবিকল আসল গাড়ির মতোই ছিল। নির্মাণের পর সব মিলিয়ে মডেল গাড়িটির ওজন দাঁড়ায় ৫.৫ টন।
এত গাড়ির মাঝে ১৯২৬ সালের প্রেসিডেন্ট মডেলের গাড়িটি বেছে নেয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কী যুক্তি ছিল সেটি জানা যায় না। তবে, সাধারণ মানুষের কাছে এই মডেলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই একে নির্বাচিত করা হয়ে থাকতে পারে।
১২২ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন যুক্ত আসল গাড়িতে ৫.৮ লিটারের ছয় সিলিণ্ডারের ইঞ্জিন সংযুক্ত ছিল। ঝাঁকুনি থেকে যাত্রীদের বাঁচাতে শক অ্যাবজর্ভার আর থার্মোস্ট্যাট সংযুক্ত ছিল ১৯২৬ মডেলের গাড়িটিতে।
সাউথ বেন্ড, ইন্ডিয়ানাতে স্টুডবেকার এক্সপেরিমেন্টাল বডি ডিপার্টমেন্ট ৪০ ফুট আকারের দৈত্যাকৃতির মডেল গাড়ি নির্মাণের পুরো কাজটি তদারক করে। ৬০ জন কর্মী এই গাড়িটি নির্মাণের কাজে অংশ নেয়, যাদের প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল পুরো কাজ সম্পন্ন করতে।
তবে নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় নির্মাতাদের। গাড়ির বিশালাকৃতির কাঠের কাঠামো নির্মাণ তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও ঢাউস আকারের এই গাড়িতে বসানোর মতো মানানসই চাকা আর টায়ার তৈরি খুব সহজ ছিল না।
দানবীয় গাড়িটির চাকাগুলো নির্মাণ করতে এগিয়ে আসে ফায়ারস্টোন টায়ার এন্ড রাবার কোম্পানি। তারা নিজেদের নাম খোদাই করা টায়ার এবং চাকা নির্মাণ করে দেয়। সেই চাকাগুলোর একেকটির হুইল বেজের আকার ছিল ৩২৫ ইঞ্চি, আর ব্যাস ছিল ৭ ফুট।
চাকাগুলোর স্পোক হিসেবে নির্মাণকারীরা বৈদ্যুতিক তার সংরক্ষণের বিশেষ ধরনের টিউব ব্যবহার করেছিল। একটি বাড়তি চাকাসহ মোট ৫টি চাকা নির্মাণ করে স্টুডবেকারকে দেয় ফায়ারস্টোন।
নির্মাণের সর্বশেষ ধাপে রঙ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়। সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় সবুজ রঙের দুটি শেডে রাঙানো হয় দানবীয় বাহনটি। পরবর্তী সময়ে যদিও এর রঙ পরিবর্তন করে উজ্জ্বল লাল করা হয়।
লম্বা সময় ধরে কাজ করার পর গাড়িটি নির্মাণ শেষে একে ব্যবহার করে ৯ মিনিটের দীর্ঘ একটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করা হয়। সে সময়ের বিজ্ঞাপন প্রচারের অন্যতম উপায় ছিল সিনেমা হলে চলচ্চিত্রের মাঝের বিরতিতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা।
সে উদ্দেশ্যেই মূলত এই ভিডিওটি নির্মাণ করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রের সাথে সংযুক্ত করা ছাড়াও সাধারণ মানুষকে বিনোদন দেয়ার জন্যে ভিডিওটি বিভিন্ন থিয়েটারে চালানোর ব্যবস্থা করে স্টুডবেকার।
বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ হবার পর গাড়িটিকে স্টুডবেকার কারখানার মেইন গেটের কাছে প্রুভিং গ্রাউন্ডে পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দেয়া হয়।
এই বাহনটি দেখতে, এর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ রোজ এসে ভীড় করতে থাকে। ভ্রমণকারী বাদেও স্টুডবেকার গাড়ি বিক্রয়ের সাথে জড়িত সকলে যেন গাড়িটির সাথে ছবি তুলতে পারে এবং প্রচারণা চালাতে পারে সে বিষয়েও নজর রেখেছিল কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু অসাধারণ গড়নের গাড়িটি নির্মাণে স্টুডবেকার যতটা আগ্রহী ছিল, এর রক্ষণাবেক্ষণে ছিল ততটাই উদাসীন। ইন্ডিয়ানার আবহাওয়া এমনিতেই খোলা স্থানে অযত্নে পড়ে থাকা কাঠের গাড়িটিকে নানাভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছিল।
সেই সাথে পাহারার ব্যবস্থা না থাকায় স্যুভেনির শিকারীরা গাড়ির নানা অংশ খুলে নিয়ে যেতে শুরু করে। নানা ধরনের সমস্যা দেখতে পেয়ে অবশেষে ১৯৩৬ সালে স্টুডবেকারের সাবেক প্রেসিডেন্ট পল জি হফম্যান এবং সেক্রেটারি জেসি মায়ার সিদ্ধান্ত নেন- ক্ষয়ে আসা, প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্থাপনাটি তারা নিজেরাই ধ্বংস করে দেবেন।
মে মাসের ১৭ তারিখে তেল ছিটিয়ে নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দেন অসাধারণ এই মডেল গাড়িতে। গাড়িটি পুরোপুরি ছাই হতে লাগে মাত্র ৩০ মিনিট।
বিশালাকার গাড়ির মডেল নির্মাণের এই যাত্রা তাদের ৪০ ফুট গাড়িতেই থেমে ছিল না। এর প্রায় দ্বিগুণ আকারের গাড়িও নির্মাণ করে তারা বিশেষ এক প্রদর্শনীর জন্য।
১৯৩৩ সালের শিকাগো বিশ্ব মেলার ট্রাভেল এন্ড ট্রান্সপোর্ট বিল্ডিংয়ে নিজেদের জন্য সংরক্ষিত অডিটরিয়ামের অভ্যর্থনা গেট হিসেবে ৮০ ফুট লম্বা, ২৮ ফুট উঁচু, এবং ৩০ ফুট চওড়া একটি অস্থায়ী গাড়ির মডেল নির্মাণ করে স্টুডবেকার কোম্পানী।
নিজেদের হাল ফ্যাশনের ল্যান্ড ক্রুজার মডেলের গাড়ির আদলে উজ্জ্বল ক্যানেরী হলুদ রঙে গাড়িটি নির্মাণ করে তারা। আগেরবারের মতো পাকাপোক্তভাবে তৈরি না করে এবার খুলে ফেলার ব্যবস্থা রেখে গাড়িটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।
কাঠের তৈরি ফ্রেমের উপরে প্লাস্টারের প্রলেপ লেপে তৈরি করা গাড়িটি সত্যিই সকল শ্রেণীর দর্শককে আকর্ষণে সক্ষম হয়। এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মেলার শেষে গাড়িটি ছোট ছোট অংশে খুলে ফেলা হয়।
তবে এত প্রচারণা এবং ইতিহাস সৃষ্টিকারী মডেল গাড়ি নির্মাণ করা সত্ত্বেও স্টুডবেকার আসল কাজটা করতে পারেনি। গাড়ি বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কোম্পানি জিএম মটরস বা ফোর্ডদের কখনোই পেছনে ফেলতে পারেনি।
যদিও ১৯২৯ সালের মার্কেট পতনের আগে তাদের ৩টি বিশাল কারখানা থেকে বছরে প্রায় ১,৮০,০০০ গাড়ি প্রস্তুত করত প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এরপর থেকেই ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে তাদের।
কোনো রকমে গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়টা পার করতে পারলেও প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকেই যেতে থাকে। এ সময়ে স্টুডবেকারের চেয়ারম্যান আত্মহত্যা করেন।
‘৩০ আর ‘৪০ এর দশকে নেয়া পর পর বেশ কিছু বাজে সিদ্ধান্ত তাদের পথচলা থামিয়ে দিতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৬৬ সালে স্টুডবেকার তাদের অ্যাসেম্বলি লাইন বন্ধ করে দেয়। এভাবেই বিশাল গাড়ি তৈরি করা এই প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের তৈরি দৈত্যাকৃতির গাড়িটির মতোই শেষ হয়ে যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ