সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। কিন্তু ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ না কমে বরং দিন দিন বাড়ছে। আর এতে চরম দারিদ্রের দিকে চলে গেছে দেশের লাখ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশে ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ না কমে বরং দিন দিন বাড়ছে। আর সরকারের ব্যয় কমছে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ, পথ্য সরবরাহ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়ের কারণে সেবা নিতে পারছে না সাধারণ মানুষ।
দেশে টেকসই অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং দরিদ্র বিমোচনের জন্য সুস্বাস্থ্য অপরিহার্য বলে জানিয়েছেন ‘ডক্টরস প্ল্যাটফরম ফর পিপলস হেলথ’র সদস্য সচিব ডা. গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর দেশে ৬৪ লাখ মানুষ শুধুমাত্র ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ, স্ট্রোক, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ, দীর্ঘায়িত জীবন এবং স্বাস্থ্য— এই তিনটিই জনস্বাস্থ্যের মৌলিক উপাদান, যা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হয়।’
বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ‘বাংলাদেশের বর্তমান জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও করণীয়’ বিষয়ক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন। ‘ডক্টরস প্ল্যাটফরম ফর পিপলস হেলথ’ এই সেমিনার আয়োজন করে।
লিখিত বক্তব্যে ডা. গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে— ‘স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক মঙ্গলজনক অবস্থা, যা নিছক রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়।’ আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা কি বলতে পারি, এই দেশের নাগরিকরা স্বাস্থ্যকে উপভোগ করতে পারছি? আমরা কি এই অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেছি? মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার কথা উল্লেখ না করে শুধুমাত্র শারীরিকভাবেও কি আমরা সুস্থ্য’?
দেশের যেকোনও উন্নয়নের জন্য পরিবেশের প্রধান উপাদানগুলো যেমন- বায়ু, জল এবং মাটিকে বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে জানান গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফার আকাঙ্ক্ষায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের কারণে বাংলাদেশ আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন।’
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও সেবার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়। চিকিৎসা ব্যয়ের সিংহভাগই ব্যক্তির নিজস্ব। ওষুধের পাশাপাশি বেশির ভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় বাইরে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, দুই দশকে দেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বেড়েছে ১২ গুণ। যতটা বরাদ্দ হচ্ছে, তার যথেষ্ট ব্যবহার করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা কি বলতে পারি, এই দেশের নাগরিকরা স্বাস্থ্যকে উপভোগ করতে পারছি? আমরা কি এই অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেছি? মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার কথা উল্লেখ না করে শুধুমাত্র শারীরিকভাবেও কি আমরা সুস্থ্য’?
দুই দশক আগে দেশে জনসংখ্যা কম ছিল। হাতের কাছে সেবাকেন্দ্র না পাওয়ার চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ ছিল কম। বর্তমানে নতুন-পুরোনো রোগ মিলে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার হার কয়েক গুণে বেড়েছে।
সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবল নিয়োগের পরও দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া যাচ্ছে না, যা স্বাস্থ্য খাতে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি বেশির ভাগ হাসপাতালেই চিকিৎসকের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না চিকিৎসকেরা। ফলে অসন্তুষ্টি বাড়ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে ৫০ লাখের বেশি চলে যাচ্ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে।
এমন সংকটাবস্থা নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যক্তির ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে।
২০১২ সালে ২০১২-৩১ সাল মেয়াদি একটি কৌশলপত্র তৈরি করে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এতে বলা হয়, ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে ২০৩২ সালে ৩২ শতাংশে আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। ওই সময়ে ব্যক্তির ব্যয় যেখানে ছিল ৬৪ শতাংশ, ২০২০ সালে এসে তা পৌঁছেছে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশে।
চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে কোন হাসপাতাল বা কার কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে সেটিও নির্ভর করে বলে জানান চিকিৎসকেরা।
বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও দেশের মাত্র ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, ৮৬ ভাগই যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। কারণ, সেবার মানের পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে চাহিদামতো ওষুধ মিলছে খুবই কম। চাহিদার মাত্র তিন শতাংশ ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গ্রামাঞ্চলে থাকা কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল এবং নগরাঞ্চলে থাকা নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, নগর প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ডেলিভারি সার্ভিসেস প্রজেক্ট ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারিভাবে মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। বাকি ৬০ শতাংশ মানুষকে এখনও সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রাপ্তিতে নানামুখী সংকট তো রয়েছেই।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে একজন ব্যক্তিকে তার চিকিৎসা ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ বহন করতে হতো। আর সরকারি ব্যয় ছিল ৩৭ শতাংশ। ২০০০ সালে ব্যক্তির ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় কমে হয় ৩৩ শতাংশ। ২০০৩ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৫৯ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় আরও কমে হয় ৩১ শতাংশ। ২০০৬ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৫৮ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ৩২ শতাংশ। ২০০৯ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬০ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২৫ শতাংশ। ২০১২ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৩ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৭ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২২ দশমিক ৮ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২০ সালে ব্যক্তির ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্যক্তি ও সরকারের বাইরে অবশিষ্ট ব্যয় বহন করে এনজিও, প্রাইভেট সেক্টর ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
এ পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে বলা যায়, গত দুই যুগে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ব্যক্তির ব্যয় ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। আর সরকারি ব্যয় কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমাতে ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ২০ বছর মেয়াদি একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছিল। ২০১২-২০৩২ মেয়াদি ওই কৌশলপত্রে বলা হয়েছিল, ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে আনা হবে। ২০৩২ সালে ব্যক্তির ব্যয় কমে হবে ৩২ শতাংশ। ২০১২ সালে কৌশলপত্র প্রণয়নের সময় ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬৩ শতাংশ। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ব্যক্তির ব্যয় আরও প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাণিজ্যিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সেবা নেওয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণে নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে।
লাইসেন্সহীন ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মেসির ছড়াছড়ি দেশব্যাপী। নকল, ভেজাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি এবং অধিক মূল্য আদায় ও প্রেসক্রিপশন ছাড়া আন্দাজে ওষুধ বিক্রিও ব্যাপক। এতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওষুধনীতি কার্যকর না হওয়ায় এসব হচ্ছে। ওষুধনীতি অনুযায়ী মডেল ফার্মেসিও করা হয়নি তেমন। এটা পর্যাপ্ত হলে ওষুধের অনিয়ম অনেক কমে যেত।
তারা বলেন, ‘একধরনের উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায় ওষুধের পেছনে। ওষুধের দামের ওপরে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ আরও বলেন, সরকার হাসপাতাল দিচ্ছে, পর্যাপ্ত জনবল দিচ্ছে না। প্রচুর মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠলেও মানসম্পন্ন চিকিৎসাশিক্ষা হচ্ছে না। রোগীরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে, এক চিকিৎসকের কাছ থেকে অন্য চিকিৎসকের কাছে দৌড়ায়। এতে খরচ বাড়ে। অসংগতিগুলো দূর করলেই ব্যক্তির খরচ অনেক কমে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৪
আপনার মতামত জানানঃ